• Home  / 
  • ফিচার  / 

বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বরগুনার কিশোরী সাজেদার অন্য রকম সংগ্রাম

Spread the love

মিজানুর রহমান, বিশেষ প্রতিনিধি

খুব ছোটবেলায় নিজের বড় বোনের বাল্যবিবাহের পর তার সংসারে নানা অসঙ্গতি সাজেদার মনটাকে বিষিয়ে তুলেছিল। এরপর সাজেদা স্থির করে সে কখনো অলপ বয়সে বিয়ে করবে না আর অন্যকে অল্প বয়সে বিয়ে হতে দেবে না। এই চিন্তা থেকেই সাজেদা বাল্য বিবাহ, কিশোরীদের বিরুদ্ধে পরিবার ও সামজিক  অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রত্যয় নেয়। নীরবে-নির্ভৃতে এই কাজের পাশাপাশি সে চালিয়ে যাচ্ছে নিজের পড়াশোনাও। সেই যে শুরু আর পেছন ফিরে তাকায়নি দরিদ্র পরিবারের এই কিশোরী। এভাবে সাজেদা নারীদের উত্ত্যক্তকারী বখাটে প্রতিরোধেও সে এগিয়ে যায়। এরই মধ্যে তার চেষ্টায় এলাকার ১০৭টি বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়েছে। ঝরে পড়া অনেক কিশোরী তার প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে এসেছে।
এসব কারণে সাজেদা আক্তারকে এ বছর ‘ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস পিস প্রাইজ’-এর জন্য বাংলাদেশ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এই পুরস্কার শিশুদের নোবেল পুরস্কার হিসেবে খ্যাত। শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্য যেসব শিশু সাহসের সঙ্গে লড়াই করে, প্রতিবছর তাদের এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০১৩ সালে এই পুরস্কার পেয়েছিল পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের হেলথ স্পেশালিস্ট মুহাম্মদ ফয়েজ কাউসার প্রথম আলোকে বলেন, সাজেদাকে এ বছর ‘ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস পিস প্রাইজের’ জন্য বাংলাদেশ থেকে তাকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

বরগুনার সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের মাইঠা গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সাজেদা আক্তার। এখন সে বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। বাবা সানু মিয়া রিকশাচালক। তিন মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে সানু মিয়ার ছয়জনের টানাপড়েনের সংসার। রিকশা চালিয়ে পরিবারের আহার জোড়ার করাই তাঁর জন্য দুরুহ। এজন্য বড় মেয়েকে পড়াতে পাড়েননি, ছেলেকে পঞ্চম শ্রেণি পড়ার পর দিয়েছে কাজে। এক শতক জমির ওপর তাদের ঘর। এই হলো সাজেদাদের পরিবার।  

প্রত্যয়ী সাজেদা জানান, আত্মবিশ্বাসই তার মূলশক্তি। বরগুনা সরকারি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত সাজেদা আক্তারের স্বপ্ন মাইঠা গ্রামকে বাল্যবিয়ে, শিশু নির্যাতন, উত্ত্যক্তকারী মুক্ত এবং যুববান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা। যে গ্রামে সবাই তাদের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে। বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে আর কোনো কিশোরী অকালে মৃত্যুবরণ করবে না। দৃঢ়তার সঙ্গে তার উচ্চারণ- একদিন আমাদের এ দেশ অবশ্যই হবে সমৃদ্ধশালী।

২০০৭ সালের কথা।  প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে ভীতসন্ত্রস্ত শিশুদের ওপর যে নেতিবাচক মানসিক প্রভাব পড়েছিল, তা কাটাতে বিদেশি সাহায্য সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল সাজেদাদের এলাকায় একটি শিশু সংগঠন গড়ে তোলে। ২০০৯ সালে ওই শিশু সংগঠনের সদস্য হয় সাজেদা। এর কয়েক মাস যেতে না যেতেই সবাই তাকে সংগঠনের সভাপতি করে দেয়। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সেটাই তার হাতেখড়ি।
২০১৩ সালে এলাকার আরেকটি সংগঠন কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্য হয় সাজেদা। ওই সংগঠনের হয়ে গ্রামে গ্রামে বাল্যবিবাহ বন্ধ, ইভ টিজিং, নেশার বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক পথনাটক, গান, সভা করতে থাকে। এতে এলাকার কিশোর-কিশোরীদের সাড়াও মেলে। এই সংগঠনে এলাকার অন্তত ১০০ কিশোর-কিশোরী সংগঠিত হয়। তারা নিজেরাই গান লেখে, সুর করে, নাটকের চিত্রনাট্য লেখে। এভাবে চলতে থাকে স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ।

বুড়িরচর ইউনিয়নের দক্ষিণ লবণগোলা গ্রামের গৃহবধূ নাসিমা আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ওর বাবা বিয়ে ঠিক করে, কিন্তু মেয়ে এতে রাজি ছিল না। বিষয়টি মেয়ের সহপাঠী সাজেদার কানে যায়। সাজেদা আমাদের বাড়িতে আসে এবং বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে আমাদের বোঝায়। এতে আমাদের ভুল ভাঙে। সাজেদা আমাদের সেই সর্বনাশ থেকে রক্ষা করেছে।’
সাজেদা বলে, ‘প্রথম দিকে এলাকার কিছু লোক এসব কাজকে ভালো চোখে দেখত না। নানা কথা বলত। কিন্তু কিছু কানে নিইনি। আমি আমার কাজ করে গেছি। এখন আমার লক্ষ্য জেলার সর্বত্র বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং ও মাদকের বিরুদ্ধে কিশোর-কিশোরীদের জাগ্রত করা।’ সাজেদা বলে, সব সময় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি এমনটা নয়। অনেক সময় জন্মসনদ দিয়ে ভোট রক্ষার জন্য জনপ্রতিনিধিরা বাল্যবিবাহতে সহযোগিতা করে এমন অভিজ্ঞতোও আছে।
মাইঠা এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য কামাল হোসেন তমাল বলেন, ‘প্রথম দিকে সাজেদার এসব কাজ আমাদের ভালো লাগেনি। পরে যখন দেখি দরিদ্র পরিবারের মেয়েটি পড়াশোনার পাশাপাশি এলাকার কিশোরীদের ওপর পারিবারিক ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে, তখন আমাদের ভুল ভাঙতে শুরু করে।

বরগুনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, সব ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্ব তৈরি ও নারীর অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের বিকশিত করার লক্ষ্যেই বরগুনা প্রেসক্লাব সাজেদাকে প্রতীকী সভাপতির দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেওয়া হয়।
গত ৫ অক্টোবর সাজেদা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগীয় ম্যানেজারের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। এ সময় সাজেদা বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. শহিদুজ্জামানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বিভাগীয় কমিশনার সাজেদার কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাকে সাত হাজার প্রনোদনা হিসেবে সাত হাজার টাকার দেন।

বরগুনার  জেলা প্রশাসক মো. মোখলেসুর রহমান আয়না২৪-কে বলেন, ‘একটি দরিদ্র পরিবারের কিশোরী যেভাবে দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ, যৌন হয়রানি, ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে নেওয়া এবং মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেটা আমাদের সমাজে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।’