• Home  / 
  • অপরাধ  / 

কেন মরণঘাতী ব্লু হোয়েল গেম তৈরি করেন ফিলিপ বুদেকিন?

অক্টোবর ১১, ২০১৭
Spread the love

আয়না২৪ ডেস্ক

যেসব মানুষ সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয় (ফিলিপ এর মতে) তাদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে তৈরি হয় ব্লু হোয়েল  গেমটি।

এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত একটি মরণ খেলা বা সুইসাইড গেমের নাম ‘ব্লু হোয়েল’। প্রযুক্তি নির্ভর এই ভয়ঙ্কর গেমটি নেশার ফাঁদে পড়ে আত্মহত্যা করতেও পিছপা হচ্ছে না তরুণ-তরুণীরা।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মরণঘাতী এই গেমের নির্মাতা কে? কেনই বা তৈরি করলেন এই গেম? চলুন জেনে নিই এ সম্পর্কে-

গেমটির নাম ‘ব্লু হোয়েল’ বা Blue whale বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘নীল তিমি’। গেমটির নির্মাতার নাম ফিলিপ বুদেকিন। ফিলিপ রাশিয়ার নাগরিক। তার ডাকনাম ফিলিপ ফক্স।

১৮ বছর বয়সে ফিলিপ ২০১৩ সালে প্রথমে ব্লু হোয়েল নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমে তিনি সামাজিকমাধ্যমে ‘এফ৫৭’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি করেন। এরপর ৫ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা করেন। ৫ বছরের মধ্যে যেসব মানুষ সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয় (তার মতে) তাদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন।

ফিলিপ যখন এই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেন তখন তিনি রাশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। তিনি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর পড়াশোনার পর ব্লু হোয়েলের বিষয়টি প্রকাশ হলে ২০১৬ সালে তাকে বহিষ্কার করা হয়। ওই সময়ে তাকে গ্রেফতার করে রাশিয়ার আইনশৃংখলা বাহিনী। গত মে মাসে এক গোপন বিচারের মাধ্যমে ফিলিপকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি সাইবেরিয়ার একটি কারাগারে দণ্ডভোগ করছেন বলে জানিয়েছে ডেইলি মেইল।

ব্লু হোয়েল গেম কীভাবে কাজ করে? ব্লু হোয়েল মোটেও ইন্টারনেট ভিত্তিক অন্যান্য সফটওয়্যার, অ্যাপ্লিকেশন কিংবা নিছক গেম নয়। এটি সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক একটি ডিপওয়ে গেম। বলা হচ্ছে, যেসব কম বয়সী ছেলে-মেয়ে অবসাদে ভোগে, তারাই অসাবধানতাবশত এই গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কোনো ক্লান্তি বা বিষণ্নতা দূর করার গেম নয়। আত্মহত্যার প্রবেশপথ মাত্র।

নেট বা গুগল কোথাও খুঁজে পাবেন না এই গেম, খুঁজে পেতে পারেন কারো পাঠানো কোনো

গোপন লিংকের মাধ্যমে। এটি একটি সুইসাইড গেইম অর্থাৎ গেম খেললে মৃত্যু অনিবার্য। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন – একটি গেম খেললে কিভাবে মৃত্যু হবে?

‘ব্লু হোয়েল’ বা Blue whale এর অর্থ নীল তিমি। নীল তিমিরা মৃত্যুর আগে সাগরের তীরে উঠে আসে – তারা আত্মহত্যা করে বলে অনেকের ধারণা! একারণেই গেমের নাম রাখা হয়েছে ‘Blue whale’ বা নীল তিমি। গেমের ৫০টি ধাপ রয়েছে। মনে রাখবেন – একবার গেমটি ইনস্টল করলে তাকে গেমের সবগুলো স্তর শেষ করার করার জন্য বাধ্য করবে অ্যাডমিন। মানে নিশ্চিত মৃত্যু।

২০১৩ সালে F57 নামক রাশিয়ান একটি হ্যাকার টিম এই গেমটি তৈরি করেছিল। তবে ২০১৫ সালে VK. com নামক সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এবং প্রচুর ডাউনলোড হয় গেমটি। রাশিয়ায় এই গেম খেলে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১৫১ জন এবং রাশিয়ার বাইরে মারা গেছে ৫০ জন।

কেন গেমটি থেকে বের হওয়া যায় না ? গেমটি মূলত একটি ডার্ক ওয়েভের (dark wave) গেম। ডার্ক ওয়েভ হলো ইন্টারনেটের অন্ধকার জগৎ। মনে রাখবে- গেমটি আপনি একবার ডাউনলোড করলে আর কখনোই আনইনস্টল করতে পারবেন না। গেমটি আপনার ফোনের সিস্টেমে ঢুকে আপনার আপনার আই পি এড্রেস, মেইলের পাসওয়ার্ড, ফেসবুক পাসওয়ার্ড কনট্যাক্ট লিস্ট, গ্যালারী ফটো এমনকি আপনার ব্যাংক ইনফর্মেশান! আপনার লোকেশান ও তারা জেনে নিচ্ছে! আর এসব তারা করছে খুব কৌশলে।

‘ব্লু হোয়েল’ গেম ওপেন করা মাত্র আপনাকে একজন অ্যাডমিন পরিচালনা শুরু করবে। গেমটির প্রথম দশটা লেভেল খুবই আকর্ষনীয়। ইউজার অ্যাডমিন কিছু মজার মজার নির্দেশনা দেন – যেমন রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠে হরর ছবি দেখা, চিল্লাচিল্লি করা, উঁচু ছাদের কিনারায় হাঁটাহাঁটি করা, পছন্দের খাবার খাওয়া ইত্যাদি। এ কারণে গেমের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন কিশোর-কিশোরীরা। আর এই কৌশলেই অ্যাডমিন হাতিয়ে নেবেন আপনার পার্সোনাল ইনফরমেশন। যা চলবে ১৫ লেভেল পর্যন্ত।

এরপর শুরু হবে পরের লেভেলগুলো ভয়ংকর সব টাস্ক। ব্লেড দিয়ে হাতে তিমির ছবি আঁকা, সারা গায়ে আঁচড় কেটে রক্তাক্ত করা, কখনো ভোরে একাকি ছাদের কার্নিশে ঘুরে বেড়ানো, রেল লাইনে সময় কাটানো, ভয়ের সিনেমা দেখা ইত্যাদি। চ্যালেঞ্জ নেয়ার পর এসব ছবি কিউরেটরকে পাঠাতে হয়। একবার এই গেম খেললে কিউরেটরের সব নির্দেশই মানা বাধ্যতামূলক। তার শেষের দিকের লেভেলে আত্মনির্যাতনমূলক বিভিন্ন টাস্ক সামনে এলেও কিশোর-কিশোরীরা এতটাই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে, গেম ছেড়ে বের হতে পারে না। আর এরই মধ্যে কৌশল পরিবর্তন করে অ্যাডমিন। আপনি টেরই পাবেন না প্রথম বিশ ধাপে সংগ্রহ করে ফেলা আপনার তথ্যের উপর ভিত্তি করে আপনাকে মোহাক্রান্ত বা হিপনোসিস পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করা হবে। আপনি তখন ভাববেন এই গেম ছাড়া আপনার বেঁচে থাকা অসম্ভব। একই সঙ্গে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দুর্ব্যবহারর মাধ্যমে আপনাকে কৌশলে নিঃসঙ্গ মানুষ বানিয়ে ফেলা হবে।

পঁচিশ লেভেলের পর নির্দেশনা আসবে মাদক বা ড্রাগ নেবার! এভাবেই সম্মোহিত করে করে আপনাকে তিরিশ লেভেল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। আর ৩১তম লেভেলে আপনার নগ্ন ছবি চাওয়া হবে! আপনি হিপনোসিস ও মাদকের কারণে নিজের নগ্ন ছবি পাঠাতেও চিন্তা করবেন না, ড্রাগ নেবার মাত্রা বাড়াতে থাকবেন আপনি!

এরপর নির্দেশনা আসবে আপনার ভালোবাসার মানুষের সাথে সেক্স করে গোপনে ছবি তুলে আপলোড করতে বা নিজের শরীরে একাধারে শ’ খানেক সুঁই ফোটাতে এবং ফটো আপলোড করে পাঠাতে। এভাবেই চলে যাবেন আপনি ৪০তম লেভেলে! এরপর আপনার জ্ঞান ফিরবে, বাঁচার আকুতি জানাবেন আপনি, কাঁদবেন আর বলবেন দয়া করে গেমটি আনইনস্টল করুন।

ওপরে বলা হয়েছে এই গেমে একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। সেটার ব্যাখ্যা ইতিমধ্যে আপনি পেয়ে গেছেন। তারপরও বলে রাখা ভালো, এই পর্যায়ে আপনাকে ব্ল্যাকমেইলিং করবে অ্যাডমিন। কারণ আপনি বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, আর গেমার টিম বা অ্যাডমিন তখন আপনারই পাঠানো সকল তথ্য ফাঁস করে দেবার হুমকি দেবে। কারণ নগ্ন ছবিসহ আপনার যাবতীয় তথ্য তখন তাদের হাতে থাকবে। তখন আপনি বাধ্য হয়ে প্রবেশ করবেন। এরই ধারাবাহিকতায় গেমের শেষ ধাপ অর্থাৎ ৫০তম ধাপে ইউজারদের এমন কিছু টাস্ক দেওয়া হয়, যা সম্পূর্ণ করা মানেই আত্মহত্যা। আর এর মাধ্যমেই ঘটে গেমের সমাপ্তি।

ব্লু হোয়েলে আসক্তদের চিনবেন কীভাবে- যেসব কিশোর-কিশোরী ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা সাধারণভাবে নিজেদের সব সময় লুকিয়ে রাখে। স্বাভাবিক আচরণ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা কাটিয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। থাকে চুপচাপ। কখনও আবার আলাপ জমায় অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অনেককে। একটা সময়ের পর নিজের শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলতে থাকে তারা।

এই মরণ ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য মনোবিজ্ঞানীরা কিছু পরামর্শ দিচ্ছেন। সেগুলো হচ্ছে-

প্রথমতো আপনাকেই সচেতন হতে হবে। কেন আপনি অপরের নির্দেশনায় কাজ করবেন। আপনি যাকে কখনও দেখেননি, যার পরিচয় জানেন না, তার কথায় কেন চলবেন বা তার কথামতো কেন কাজ করবেন- সেটি নিজেকেই চিন্তা করতে হবে। এরকম কোনো লিংক সামনে এলে তাকে এড়িয়ে চলতে হবে। সমাজের তরুণ-তরুণীদের মাছে এই গেমের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে।

সন্তান, ভাই-বোন বা নিকটজনকে মোবাইলে ও কম্পিউটারে অধিক সময়ে একাকী বসে থাকতে দেখলে সে কী করছে, তার খোঁজ-খবর নিতে হবে। সন্তানকে কখনও একাকী বেশি সময় থাকতে না দেয়া এবং এসব গেমের কুফল সম্পর্কে বলা।

সন্তানদের মাঝে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মানসিকতা সৃষ্টি করা। যাতে তারা আত্মহত্যা করা বা নিজের শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করা অনেক বড় পাপ- এটা বুঝতে পারে। সন্তান ও পরিবারের অন্য কোনো সদস্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিনা- সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা। কেউ যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় তাকে সঙ্গ দেয়া।

কৌতূহলি মন নিয়ে এই গেমটি খেলার চেষ্টা না করা। কৌতূহল থেকে এটি নেশাতে পরিণত হয়। আর নেশাই হয়তো ডেকে আনতে পারে আপনার মৃত্যু।

এ পর্যন্ত ব্লু হোয়েল পৃথিবীর কোন কোন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, চিলি, চীন, ভারত, ইটালি, কেনিয়া, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, সৌদি আরব, সাইবেরিয়া, স্পেন, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও উরুগুয়ে ব্লু হোয়েল শনাক্ত হয়েছে।