আয়না ২৪ অনলাইন ডেস্ক
বার্লিনের প্রাণকেন্দ্র জিগে সয়েলে বা বিজয়স্তম্ভসংলগ্ন রাস্তায় এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। ২০০৮ সালের ২৪ জুলাই এখানেই দুই লাখ মানুষ জমায়েত হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কথা শুনবে বলে। রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক কোনো নেতার বক্তব্য শুনতে এত বিপুলসংখ্যক লোকের জমায়েত শুধু বার্লিনে কেন, সারা ইউরোপেই বিরল ঘটনা। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সেটি ছিল তাঁর প্রথম ইউরোপ সফর। আট বছর ক্ষমতায় থাকার পর গত নভেম্বর মাসে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেষবার ইউরোপ সফর করলেন, বক্তব্য দিলেন অ্যাথেন্স ও বার্লিনে। বললেন গণতন্ত্রের মর্মকথা এবং একযোগে তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বের কথা। কিন্তু ওবামার এই নির্ভার বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারছেন না ইউরোপের মূলধারার রাজনীতিকেরা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের চলে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে অতি জাতীয়তাবাদের বিজয়, পাশাপাশি দেশে–দেশে কট্টরপন্থীদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় সংশয়ে পড়েছে ইউরোপীয় রাজনীতি।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বিধ্বস্ত হওয়ার পর জর্জ ডব্লিউ বুশের বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণায় ইউরোপের প্রায় সব দেশ আমেরিকার পাশে দাঁড়িয়েছিল। ইউরোপ-আমেরিকার মধ্যে বন্ধুত্ব এবং উভয় উভয়ের পাশে দাঁড়ানোর নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ৭০ বছরে অব্যাহতই ছিল। তবে গত আট বছরে আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পাশের রাজনীতিতে অনেক গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে, আতঙ্ক-আশঙ্কার দোলাচলে দুলছে দুই মহাদেশেরই মানুষ।
তবে এখন যে বিষয়গুলো নিয়ে ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমত হতে পারে তা হলো, মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে শর্তসমূহের পরিবর্তন ও ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি, বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসার চিন্তা এবং ন্যাটো সামরিক জোটের কর্মপরিধি ছেঁটে ফেলা, ইউরোপের মধ্যপ্রাচ্যনীতির সঙ্গে মতভেদ এবং রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান সম্পর্ক।
সদ্য সমাপ্ত ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত বক্তব্যে ইউরোপ-আমেরিকা সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। নির্বাচনের আগেই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সভাপতি মার্টিন শুলজ বলেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তা শুধু ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, সারা বিশ্বের জন্যই সমস্যাবহুল হবে। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে সামাজিক গণতান্ত্রিক দলের সংসদীয় কমিটির সভাপতি ইতালির গিয়ান্নি পিটাল্লে বলেছেন, ব্যক্তি ট্রাম্পকে আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক, আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁকে এবং তাঁর সমর্থকদের আমাদের সম্মান করতেই হবে। তবে আশঙ্কা এই, ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতি জাতীয়তাবাদ ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থায় ভাইরাসের মতো কাজ না করে। তিনি আরও বলেন, ইউরোপের নানা দেশে অতি জাতীয়তাবাদী যে দলগুলো মিথ্যা জনতুষ্টিবাদ ও শরণার্থী সমস্যাকে পুঁজি করে ইতিমধ্যেই তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে, রাজনীতি দিয়ে তা মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেট ও কাউন্সিলের সভাপতি জ্যঁ ক্লদ ইয়ুঙ্কার ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ের পর অভিনন্দনপত্র পাঠালেও অনুযোগের সুরে বলেছেন, ‘নানা বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও ট্রান্স–আটলান্টিক ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রাখতে ইউক্রেন বিষয়ে এবং আইএস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় দেশগুলোতে উদারনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক রাজনীতি ভালোই করছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকেরা বর্ণবাদ, জাতি-ধর্মবিদ্বেষের বিপক্ষে এবং নারী অধিকার, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ, ইউরোপীয় ঐক্য ও বিশ্বায়নের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর সঙ্গে একমত ছিলেন। ইউরোপের মূলধারার রাজনীতিকেরা ধরেই নিয়েছিলেন তাঁদের এই উদারনৈতিক পুঁজিবাদী মূল্যবোধের রাজনীতি ভবিষ্যতে সারা বিশ্বই গ্রহণ করবে।
তবে বিধি বাম! আমেরিকা তো দূরে থাক এখন খোদ ইউরোপেই এই উদারনৈতিক রাজনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। জার্মানির বিখ্যাত বারটেলসম্যান ফাউন্ডেশন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে কট্টরবাদীদের রাজনীতি অনেক ভোটারের কাছে কেন এত জনপ্রিয় হচ্ছে, তা বোঝার জন্য একটি জরিপ করেছে। সদ্য সমাপ্ত ‘বিশ্বায়নের সম্ভাবনা ও মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব’ শীর্ষক এই জরিপে ৪৫ শতাংশ মানুষ বলেছে, বিশ্বায়নের কারণেই অভিবাসীদের ভিড় বাড়ছে এবং তাতে করে তারা ভীত ও উদ্বিগ্ন। তবে ৫৫ শতাংশ মানুষ বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে বলেছে। সমীক্ষা আরও জানিয়েছে, এই আতঙ্ক-উদ্বেগ গত দুই বছরে বেড়েছে। এ সময়েই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে শরণার্থীদের আগমন এবং প্যারিস ও ব্রাসেলসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। তার পর থেকে ইউরোপে কট্টরপন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়কে পুঁজি করেও ইউরোপের কট্টরবাদীরা তাদের পালে আরও বাতাস লাগাতে চাইছে।
এই মুহূর্তে ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও হল্যান্ডে কট্টরপন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলো ভালো অবস্থানে রয়েছে। এদের জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি ইসলামবিদ্বেষ এবং শরণার্থী ও অভিবাসীবিদ্বেষ। কেন শরণার্থীরা নিজভূমি ছাড়ছেন বা কেন এই যুদ্ধ, সেই ব্যাপারে কোনো মানবিক ভাবনা বোধ বা দায়ভার তাদের রাজনীতিতে অনুপস্থিত। এসব দেশকে যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ায় পাশ্চাত্যের দায়টাও যে কম নয়, সেটা তাঁরা জনগণের সামনে থেকে লুকাচ্ছেন। ট্রাম্পের বিজয় আগামী বছর অনুষ্ঠেয় ফ্রান্সের নির্বাচনে উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ন্যাশনাল দলের নেত্রী ম্যারি লো-পেন এবং আগামী মার্চে হল্যান্ডের পার্লামেন্ট নির্বাচনে গ্রিড ভিল্ডারের অবস্থানকে আরও শক্ত করবে।
শুধু আমেরিকা নয়, ডান পন্থার জনপ্রিয়তা ঠেকাতে ইউরোপে নেতৃত্বেরও সংকটকাল চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের চলে যাওয়া বা ফ্রান্সের ক্ষমতাসীন সামাজিক গণতান্ত্রিক দলের নেতা ওলাঁদের অর্থনীতিসহ বেকার সমস্যার সুরাহা না করা এবং উপর্যুপরি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে ডানপন্থীদের ক্ষমতায়ন এই সংকটের প্রমাণ। তবে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এই মুহূর্তে একমাত্র ইউরোপীয় নেত্রী, যিনি শত সমালোচনার মুখেও ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থীকে জায়গা দিয়ে এবং অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটিয়ে অবস্থান ধরে রেখেছেন। এই মুহূর্তে ইউরোপীয় ঐক্য, ইউরোপীয় মূল্যবোধ এবং মানবিকতার রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের বিকল্প নেই।
তবে ক্ষমতায় গিয়ে ইউরোপীয় মতাদর্শের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপরই নির্ভর করছে আগামী দিনের ইউরোপ-আমেরিকার সম্পর্ক।