ত্লাবং ঝর্ণা বা ডাবল ফলস বান্দরবন জেলার অন্যতম আকর্ষনীয় জলপ্রপাত যা দ্বৈত ঝর্ণা কিংবা জোড়া ঝর্ণা বা ক্লিবুং খাম নামেও পরিচিত। এটি রিমাক্রি খালের আদ্যস্থল। দুটি প্রবাহ প্রানশা বা প্রাংশা (বামে) ও পাঙ্খিয়াং বা পাংখিয়াং (ডানে) ঝিরি মিলে দুটি আকর্ষনীয় জলপ্রপাত তৈরী হয়েছে। ২টা ঝর্ণা একসাথে থাকার কারণের একে ডাবল ফলস বলা হয়। এটি বম গ্রাম হতে মাত্র ২.৫ কিমি দক্ষিণ-পূর্ব এবং কেওক্রাডং থেকে ১-২ ঘন্টা দূরত্বে অবস্থিত। সঠিক করে বলতে গেলে ত্লাবং ঝর্ণা সুংসাং পাড়ার নিচেই অবস্থিত। সুংসাং পাড়া আর থাইক্ষাং পাড়ার মাঝের জঙ্গলের অত্যন্ত গভীরে অবস্থিত এই ঝর্নাটি।
সুংসাং পাড়ার বমদের থেকে জানা যায় যে , প্রায় ৩০-৪০ বছর আগে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা মানুষ মেরে এই ঝর্নার উপর থেকে নিচে ফেলে দিত। সুংসাং পাড়া আর্মি ক্যাম্প এর স্থানে ১৯৯০ এর দিকে মিজোরাম সন্ত্রাসীদের ঘাটি ছিল। ওইসময় এই রকম ঘটনা অনেক ঘটেছে বলে জানান তারা। সুনসানপাড়া পাড়ার কারবারি থেকে জানা যায় যে “ত্লাবং ” একটি বম শব্দ। এর অর্থ “পানি ধরে রাখার বেসিন বা গর্ত” ।
সুংসাং পাড়া থেকে সরল বিস্তৃতির লাল মাটির একটা ট্রেইল এগিয়েছে থাইক্যাং পাড়ার দিকে। সেই পথ ধরে ঘণ্টাখানেক হাঁটলেই দেখা মিলবে তলাবংয়ের। আর এই পুরো যাত্রাপথে ডানপাশে চোখ ফেরালেই আপনাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য সর্বদা হাজির অনিদ্যসুন্দর কপিতাল পাহাড়। আর চোখ জুড়ানো সব জুমঘর তো আছেই। স্থানীয় অধিবাসীরা একে তলাবং নামেই ডেকে থাকেন। পাথুরে খাল রেমাক্রির উৎপত্তি এই ঝরনা থেকেই।
ট্রেইলঃ রুমা – বগালেক – কেওক্রাডং – পাসিং পাড়া – সুংসাং পাড়া – ত্লাবং ঝর্ণা
কিভাবে যাবেনঃ
ত্লাবং ঝর্ণা দেখতে হলে ঢাকা থেকে বান্দরবানগামী রাতের বাসে চেপে বসতে হবে। এই পথে চলাচল করে ডলফিন, শ্যামলী, এস আলম সার্ভিসসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের বাস। ভাড়া ৬০০-৭০০ টাকা। বান্দরবান থেকে বাস বা চান্দের গাড়িতে করে যেতে হবে রুমা সদর উপজেলা। বাস ভাড়া ১০০ টাকা। প্রতি এক ঘণ্টা পরপর একটি করে বাস বান্দরবান থেকে রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। সেখান থেকে পরবর্তী গন্তব্য বগা লেক। বগালেক পৌঁছাতে পারেন দুভাবে। ঝিরিপথে হেঁটে বগা পৌঁছাতে সময় লাগে ঘণ্টা চার-পাঁচেক। আর চান্দের গাড়িযোগে বগা পৌঁছাতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। রুমা বাজার থেকে চান্দের গাড়িযোগে বগা লেক পৌঁছাতে গুনতে হবে ১৮০০-২৫০০ টাকা।
বগা লেক থেকে পরের পথটুকু ট্রেক করে এগোতে হবে। ঘণ্টা তিনেক হাঁটলেই দার্জিলিংপাড়া হয়ে পৌঁছে যাবেন বাংলাদেশের পঞ্চম উচ্চতম শৃঙ্গ কেওক্রাডংয়ে। মেঘে মেঘে ষোলোকলার সঙ্গে মিতালি করে কেওক্রাডং পাহাড়ের চূড়া! এরপর কিছুটা হাঁটলেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গ্রাম পাসিংপাড়া। পায়ের নিচেই মেঘ আর বৃষ্টির লুটোপুটি। আচমকা হাওয়ায় মেঘে ঢেকে যায় দেহ, ওহ্! চোখে না দেখলে কারও সাধ্য নেই অন্যকে বোঝানো। এবার নিচে নামার পালা, প্রায় এক হাজার ফুট নিচে সুংসাংপাড়া। পাথুরে রাস্তা, দিগন্ত ছোঁয়া বৃক্ষরাজি, অরণ্যের সাপ-ব্যাঙের লুকোচুরি অবলোকন করতে করতে সুংসাং পাড়ায় এসে হাজির হবেন। চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত সুংসাংপাড়া পেছনে ফেলে গভীর অরণ্য আর ঝিরি মাড়িয়ে বীরদর্পে এগিয়ে যেতে হবে আপনাকে। দু-চারটি জোঁক মামা কখন যে রক্ত চুষে নিবে টেরই পাবেন না। প্রায় দু’ঘণ্টা হাঁটার পর অবারিত পানি পড়ার রিমঝিম শব্দ কানে ভেসে আসবে আপনার। বুঝবেন, এবার সময় হয়েছে ডাবল ফলসের স্বচ্ছ টলটলে হিমশীতল জলে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে একটু ভিজিয়ে নেওয়ার।
থাকা-খাওয়াঃ
ত্লাবং যাত্রাপথে প্রথম রাতটা কাটাতে পারেন বগা লেক পাড়ায়। এখানে পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। সিয়াম দিদি কিংবা লারামের দোতলা কাঠের বাড়িগুলোতে থাকতে গুনতে হবে জনপ্রতি ২০০ টাকা। এখানে ডিম ভাজি-আলু ভর্তাসমেত খিচুড়ি মিলবে ১০০ টাকায়। পরের দিন ত্লাবং ঝর্ণা দেখে পরের রাতটা কাটাতে পারেন সুংসাংপাড়ায় রবার্ট বমের ঘরে। পাড়া থেকে চাল-তরকারি সংগ্রহ করে রান্না করতে হবে নিজেদেরই। ২০০ টাকায়ই থাকার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে এখানে। পাহাড়ি মুরগির ঝোল দিয়ে ধোঁয়া ওঠা জুমের চালের ভাত খেতে পারবেন শ-খানেক টাকার বিনিময়েই। যে জায়গায়ই থাকুন না কেন, সকালে উঠে ঢুলুঢুলু চোখে পায়ের নিচে মেঘের সমুদ্র দেখাটা কিন্তু এককথায় নিশ্চিত।
খরচঃ ঢাকা থেকে চার-পাঁচজনের দলের যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া আর গাইড খরচ মিলিয়ে জনপ্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হবে।