চির বিদায় নায়করাজ রাজ্জাক

আগস্ট ২২, ২০১৭
জন্ম: ২৩ জানুয়ারি ১৯৪২ ; মৃত্যু: ২১ আগস্ট ২০১৭
Spread the love

আয়না ২৪ ডেস্ক

কাল সন্ধ্যায় জনস্রোত বয়ে গিয়েছিল রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। শোকার্ত মানুষ শেষবারের মতো একনজর দেখতে চাইছিল তাদের প্রিয় নায়ককে। সংবাদমাধ্যমে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল খবর: নায়করাজ রাজ্জাক আর নেই। বিকেল পাঁচটার দিকে অসুস্থ বোধ করলে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

রাজ্জাকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হলো বাংলা চলচ্চিত্রের একটি অধ্যায়। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে যাঁদের হাত ধরে আমাদের দেশে শিশু চলচ্চিত্র দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, তাঁদের মধ্যে উজ্জ্বল এক নাম রাজ্জাক। দীর্ঘ অভিনয়জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি জয় করেছিলেন এ দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের হৃদয়।

রাজ্জাকের সবচেয়ে আদরের ছেলে সম্রাট। বাবার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল তাঁরই। ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন আর যাঁকে কাছে পাচ্ছিলেন জড়িয়ে ধরছিলেন। বলছিলেন, ‘রাত ১০টা বাজলেই আমাকে ফোন করে বাবা বকা দিত। ধমক দিয়ে বলত, কোথায়? জলদি এসো, খাব। আমি বলতাম, বাবা তুমি খেয়ে নাও। আমি আসার পরে আবার একসঙ্গে বসে খাব। তখন বাবা বলতেন, তুমি এখনি আসো। তুমি আসার পরে খাব। আমি বলেছি, বাবা ২০১৯ সাল পর্যন্ত অমিতাভের কোনো শিডিউল ফাঁকা নেই। তুমি কেন কাজ করছ না? তখন বাবা বলেছেন, আমার জন্য বিষয় বানাও, আমি কাজ করব। আমি বলতাম, এই শরীর নিয়ে কাজ করবেন কীভাবে? ডায়েট করতে হবে। বাবা তখন ডায়েটের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেছিলেন।’

রাজ্জাকের সঙ্গে কাজ করেছেন মজনু ফিল্মসের স্বত্বাধিকারী মুজিবুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে ৫৩ বছরের সম্পর্ক। রাজ্জাকের জন্যই আমি সিনেমায় এসেছি। সময়-অসময়ে তাঁর বাড়িতে যাতায়াত করেছি। কত যে অত্যাচার করেছি ওই বাড়িতে, তা বলার নয়।’

সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন অভিনয়শিল্পী সুচরিতা, শাকিব খান, ফেরদৌস, সাইমন সাদিক, জায়েদ খান, অরুণা বিশ্বাস, ওমর সানী, মৌসুমী, আইরিন, রোশান, পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার, গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, নৃত্যপরিচালক মাসুম বাবুল প্রমুখ।

শূন্য থেকে নায়করাজ

নায়করাজ রাজ্জাকের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি। অবিভক্ত ভারতের কলকাতার কালীগঞ্জের নাকতলায় তিনি জন্মেছিলেন। তাঁর আট বছর বয়সে বাবা আকবর হোসেন ও মা নিসারুন্নেসা দুজনই মারা যান। ৩ ভাই, ৩ বোনের সংসারে বড়রা রাজ্জাককে বুঝতেই দেননি বাবা-মায়ের শূন্যতা। ছোটবেলায় পড়তেন খানপুর হাইস্কুলে। এ কথা এখন অনেকেই জানেন যে কৈশোরে রাজ্জাকের ইচ্ছা ছিল ফুটবলার হওয়ার। গোলরক্ষক হিসেবে খেলতেন ভালো। বিভিন্ন পাড়ায় হায়ার করেও নিয়ে যাওয়া হতো তাঁকে।

রাজ্জাক যে পাড়ায় থাকতেন, সে পাড়ায়ই থাকতেন ছবি বিশ্বাস (কাঞ্চনজঙ্ঘা, জলসাঘরসহ অসংখ্য বাংলা ছবির শক্তিমান অভিনেত্রী), সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনয়শিল্পীরা। ছবি বিশ্বাস বিপুল উৎসাহ নিয়ে আবৃত্তি শেখাতেন পাড়ার শিশু-কিশোরদের। রাজ্জাকও তাঁর কাছে আবৃত্তি শিখেছেন।

শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্কুলেই একটি নারীবর্জিত নাটক করতে চাইলেন, নাম বিদ্রোহী। স্কুলের মেয়েরাও রাজ্জাকের অভিনয়ের তারিফ করল। তাতে অভিনয়ের প্রতি মনোযোগী হন রাজ্জাক। পাড়ার শক্তি সংঘ ক্লাবে অভিনয় করলেন নতুন ইহুদি নাটকে। এরপর তরুণতীর্থ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীতে নিয়মিত অভিনয় করা শুরু করেন তিনি। এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন ছবি বিশ্বাস। নাট্য পরিচালক ছিলেন পীযূষ বোস।

ঢাকার কমলাপুরে ছোট্ট একটি বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। আয়রোজগার নেই। যে টাকা এনেছিলেন, তাও ফুরিয়ে গেল।

অভিনয়ের সুযোগ সেভাবে হয়নি, পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। কাগজের নৌকা, কাগজের বৌ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন ছবিতে ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেন। ভালো চরিত্রের জন্য কেউ তখনো তাঁকে ডাকেনি।

এরই মধ্যে দেখা হলো জহির রায়হানের সঙ্গে। জহির তাঁকে তাঁর পরবর্তী ছবি হাজার বছর ধরে-এর নায়ক হিসেবে নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে সে ছবিটি আর হয়নি।

১৯৬৬ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন কাজ শুরু করে। খবর পাঠক হিসেবে তিনি ইন্টারভিউ দিলেন। টিকেও গেলেন। কিন্তু অভিনেত্রী রেশমার স্বামী জামান আলী খান তাঁকে অভিনয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পরামর্শ দিলেন। এরই মধ্যে অভিনয়শিল্পী মোহাম্মদ জাকারিয়া তাঁকে জানালেন, জহির রায়হান হন্যে হয়ে খুঁজছেন তাঁকে। বেহুলা ছবির নায়কের চরিত্রে জহির রায়হান নিলেন রাজ্জাককে। রাজ্জাক পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলেন ছবিটি করে। এরপর জহির রায়হানের আগুন নিয়ে খেলা ছবি করে পেলেন সাত হাজার টাকা। রাজ্জাক পায়ের নিচে দাঁড়ানোর মতো মাটি পেলেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরও রাজ্জাক ছিলেন খ্যাতির শিখরে। ওরা ১১ জনঅবুঝ মনরংবাজ-এর মতো ছবি করেছেন। নারায়ণ ঘোষ পরিচালিত আলোর মিছিল ছবিটি ছিল ব্যতিক্রমী। অনন্ত প্রেম ছবিটির কথাও মানুষ অনেক দিন মনে রাখবে। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে আছে অগ্নিশিখাঅশিক্ষিত ও ছুটির ঘণ্টা

দীর্ঘ অভিনয়জীবনে তিনি সুচন্দা, কবরী, শাবানা, ববিতা, রোজিনার সঙ্গে একের পর এক সফল জুটি উপহার দিয়েছেন।

২০১৪ সালে তাঁর অভিনীত কার্তুজ তাঁর শেষ ছবি।

রাজ্জাক অভিনয় ছাড়া পরিচালনাও করেছেন। তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি অনন্ত প্রেম। বাংলা-উর্দু মিলিয়ে তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক।

দীর্ঘ অভিনয়জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে আছে স্বাধীনতা পদক (২০১৫), পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সেরা অভিনেতা), মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০১৪।

শোকবার্তা

নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ শোকবার্তায় বলেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তা অর্জনে নায়করাজ রাজ্জাকের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘বাঙালি সংস্কৃতি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্মরণ করবে।’প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকবার্তায় চলচ্চিত্র জগতে রাজ্জাকের অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র।’

এ ছাড়া বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমির ফয়সল মুজাদ্দেদী প্রমুখ গভীর শোক প্রকাশ করেন।

পৃথক বার্তায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন কিংবদন্তি এই অভিনেতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে।