জসিম উদ্দীন মেহেদি, ঝালকাঠি
ঝালকাঠিতে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে জমজমাট হয়ে উঠেছে মাদকের বাজার। পেশাদার মাদক ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে মৌসুমী মাদক ব্যাবসায়ীরাও। মাদকের নীল ছোবলে বিপথগামী হচ্ছে এলাকার তরুণ ও যুবকেরা। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা বড়ির মত জীবনঘাতী মাদক।
গত এক সপ্তাহে ঝালকাঠির বিভিন্ন উপজেলার থেকে কয়েক হাজর ইয়াবা বড়িসহ বেশ কিছু মাদক ব্যাবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে আইন শৃংখলা বাহিনী। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যাক্তিদের মধ্যে কলেজ শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিরা রয়েছেন। ইয়াবার ব্যাপক বিস্তার এবং সেবনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিক্রির সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতায় স্থানীয় সচেতন মহল ও প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র বলছে, সপ্তাহে রাজাপুর উপজেলা বিএনপি সহসভাপতি ও আলহাজ্ লালমোন হামিদ মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মো. মাহফুজুর রহমানকে ৫০ টি ইয়াবাবড়িসহ গ্রেপ্তার করে বরিশাল গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। এর একদিন আগে জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলা থেকে ২৬০০ টি ইয়াবা বড়িসহ আবুল কালাম নামে এক মাদক ব্যাবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রাজাপুরের হালদারখালী বাজার থেকে অভিজিৎ সরকার নামে এক ওষুধ ব্যবসায়ীকে ২৪৩ টি ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে র্যাবের-৮ সদস্যরা। এছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও মাদক সেবনকারী-ব্যবসায়ীরা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছে। এসব ঘটনা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাকদের মধ্যে দুঃশ্চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজ পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, আমরা সন্তানদের নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকি। যখন দেখি কলেজের শিক্ষক ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয় তখন আমরা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাইনা। বর্তমানে মাদক এমন একটি ব্যাধির নাম যার কোন প্রতিকার আছে বলে মনে হয় না। কারন এই মাদক ব্যাবসার সাথে ছোট-বড় রাজনৈতিক নেতারা জড়িত। তারা তাদের সহযোগীদের দিয়ে মাদক বিক্রি করায়। তাই এই চক্রের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে।
বর্তমানে রাজাপুরে মাদক বিকিকিনি ও সেবনের অন্যতম স্পটগুলোর মধ্যে পূর্ব চর রাজাপুর এলাকা সবচেয়ে বেশি পছন্দের মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের কাছে। কারন ওই স্থান থেকে রাজাপুরের সকল স্থানে সহজে যাতায়ত করা যায়। দিন-রাত সমানতালে ওই এলাকায় মাদক বিক্রি হচ্ছে বলে চর রাজাপুর এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন। এখানে থানা পুলিশের নজরদারি নেই বললেই চলে।
এছাড়া বাঘড়ি বাজার হয়ে ইন্দ্রপাশা গ্রামের মধ্য থেকে সাউথপুর সেতু এলাকার সড়কটি এখন মাদক বেচা-কেনার নিরাপদ স্থান। এখান থেকে বাইপাস এলাকার বাদুরতলা মোড়, ডাকবাংলো মোড়, মেডিকেল মোড়, বাঘরি ব্রিজের বালুর গোলা সহ উপজেলা সদরের অন্তত ২০-২৫টি স্পটে ঈদকে সামনে রেখে জমে উঠেছে মাদকের বাজার।
উপজেলার বাদুরতলা বিষখালী নদীরপাড়, বড়ইয়া, গাজীরহাট, পুটিয়াখালি, গালুয়া ও নলবুনিয়া, বাগড়ি, পিংড়ি, বাড়ৈবাড়ি, হাইলাকাঠি, ইন্দ্রপাশা, সাংগর, তারাবুনিয়া, কানুদাশকাঠি, কেওতাসহ বিভিন্ন এলাকায় চলছে মাদকের রমরমা ব্যবসা। এসব স্পটগুলোতে মাদক বিক্রেতা ও ক্রেতাদের আনাগোনা চোখে পড়ার মত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদকসেবী এক যুবক জানায়, বর্তমান বাজারে ইয়াবা চলছে বেশি। কারন এগুলো আকারে ছোট হওয়ায় বহনে সুবিধা এবং দামে সস্তা। উপজেলার এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে ইয়াবা পাওয়া যায় না। এছাড়া ফেনসিডিলের দাম বেশি হওয়ায় চলে কম। রাজাপুরে শুধুমাত্র গালুয়া এলাকায় ফেন্সিডিল পাওয়া যায়।
ওই যুবক আরো জানায়, বর্তমানে মাদক ব্যাবসায়ীরাও প্রযুক্তির সহয়তা নিয়ে মাদক ব্যাবসা পরিচালনা করছে। মাদক ব্যাবসায়ীদের মুঠোফোনে প্রশাসন আঁড়ি পাতে তাই তারা ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে মাদক সম্পর্কে বেচাবিক্রি করছে। এছাড়াও কোনো মাদক ব্যাবসায়ী এখন সরাসরি মাদক হাতে দেয়না। আগে থেকেই বিভিন্ন স্থানে মাদক রেখে দেওয়া হয়। টাকা হাতে পেলে সেই স্থানগুলোর কথা জানিয়ে দেওয়া হয় ক্রেতাদের। এভাবেই বর্তমানে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজাপুরে মাদক ব্যাবসা পরিচালিত হচ্ছে।
ওই যুবক আরো জানায়, উপজেলার সাতুরিয়া, গালুয়া ও রাজাপুর সদরের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রাজনৈতিক পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে রাজাপুরে মাদক ব্যাবসার জাল ছড়িয়ে রেখেছে।
এ বিষয় জানতে চাইলে রাজাপুর থানা পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হারুন অর রশীদ বলেন, মাদক ব্যাবসায়ীদের গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। বিভিন্ন সময় মাদক ব্যাবসায়ী ও সেবনকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তবে মাদক নির্মূলে আইন প্রয়োগের চেয়েও বেশী প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা এবং সামাজিক প্রতিরোধ।