তাঁদের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে , কাঁধে বন্দুক হাতে। মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তুমুল লড়াইয়ে তখন নেমে পড়েছেন ফিদেল । সালটা ছিল ১৯৫৩। বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা লড়াইয়ের প্রথম ধাপ। স্বেচ্ছাচারী সরকারের ভীত উপড়ে ফেলার প্রাথমিক চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন কাস্ত্রো। তাঁকে বন্দী করা হল।
কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই দেশ ছেড়ে কাস্ত্রো ছুটলেন মেক্সিকো। ওদিকে লাতিন আমেরিকার নানা প্রান্ত চষে মেক্সিকোতে ঘাঁটি গেড়েছেন আরেক টগবগে এক যুবাক। যিনি পেশায় চিকিৎসক। নাম আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। জেল–পালানো কাস্ত্রো বিপ্লবের রসদ জোগাড়ে ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন মেক্সিকোতে। ’৫৩ সালে সেদেশেই চের সঙ্গে দেখা হল কাস্ত্রোর। ফুলের মতো দেশ ম্যাক্সিকো। ফলেল শোভিত এই মনোরম দেশে দুই বাম–বিপ্লবীর চোখে তখন সাম্যদের স্বপ্ন। তাঁদের যৌথ খামারের আদর্শই শেষ পর্যন্ত অবিকল্প এক বন্ধুত্বে জুড়ে দিয়েছিল বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা দুই রাজপুত্রকে।
১৯৫৩ সাল। কিউবা তখনও যে পীড়িত! ভাই রাউল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা–কে নিয়ে ফের দেশে ফিরলেন কাস্ত্রো। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর, রাউল, ফিদেল, গুয়েভারা পা রাখলেন কিউবায়। মাত্র ৮২ জনকে নিয়ে শুরু হল গেরিলা যুদ্ধ, মিলিশিয়াই তখন সাম্যবাদী আদর্শের চর্চা, মিলিটারি ট্রেনিং। গেরিলা যুদ্ধের তাঁবুতে, কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া গুলির শব্দে, পোড়া বারুদের গন্ধে আরও গাঢ়, আরও নিবিড় হয়ে উঠল ওদের সখ্য। লড়াকু বিপ্লবী দলে কাস্ত্রোর পরেই ‘সেকেন্ড ইন কম্যান্ড’ হয়ে উঠলেন চে। শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের পরতে পরতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমেরিকার পদলেহনকারী সরকারকে উপড়ে ফেললেন দুজন মিলে। যুদ্ধজয় যেন তাঁদের সম্পর্ককে আরও মধুর করল । সারা পৃথিবীর কমিউনিস্টদের কাছে যেমন করে মার্কস আর এঙ্গেলসের বন্ধুত্ব এক অনন্য উদাহরণ, তেমনি দৃষ্টান্ত গুয়েভারা–ফিদেল।
ক্বিউবা বিপ্লবের পর নতুন সরকার এল কিউবায়। নায়ক ফিদেল হলেন প্রধানমন্ত্রী। গুয়েভারাকেও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হল। প্রথমত, কাস্ত্রোর প্রশাসনে যুদ্ধবন্দীদের বিচারের বিষয়, জমি বণ্টন ও শিল্পের বিষয়, জনশিক্ষা, কিউবার সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও জাতীয় ব্যাংকের কাজকর্ম দেখভালের পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভার নিলেন চিকিৎসক চে গুয়েভারা। কিন্তু তখনও ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে আমেরিকা।
১৯৬২ সালের কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের সময়ে নাকি চে গুয়েভারাই রাশিয়ার ব্যালিস্টিক মিসাইল দেশে রাখার বিষয়টিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। শক্তিধর আমেরিকার নাকের ডগায় বসে এমন স্পর্ধা দেখানোর ক্ষমতা কাস্ত্রো–গুয়েভারা ছাড়া আর কারই বা হয়েছে! তবু শেষ পর্যন্ত এমন কী হল! কাস্ত্রো সরকারের সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে চে চললেন বিপ্লবের সন্ধানে। ’৬৫ সালে বলিভিয়ার মুক্তির লড়াইয়ে যোগ দিতে পাড়ি দিলেন তিনি। ’১৯৫৩ থেকে ১৯৬৫— এক যুগের রক্তিম বন্ধুত্বের স্বপ্ন সময় কাটিয়ে প্রথম আলাদা হলেন কাস্ত্রো ও গুয়েভারা। কেন? আছে নানা মত। যদিও একটাই কথা যেন সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। গুয়েভারা বলেছিলেন, ‘কিউবা ছাড়ছি। আসলে আমার ভূমিকা প্রশাসকের নয়, বিপ্লবীর। মেহনতি মানুষের মুক্তির লড়াই, বিপ্লব, সমাজতন্ত্র আমায় ডাকছে, তাই চললাম বলিভিয়া।’
কিন্তু কাস্ত্রো? ২০০৫ সালে, ফিদেল যখন ক্রমে বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তখনই বরাবরের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের মতো এক ইংরেজ সাংবাদিক এক নতুন দাবি করলেন। বললেন, বলিভিয়ায় যখন সি আই এ–র মদতপুষ্ট সরকারি বাহিনী চে গুয়েভারাকে খুন করল, সেই লড়াইয়ের ময়দান থেকে চে গুয়েভারাকে উদ্ধার করতে চেয়েছিল কিউবার গেরিলা বাহিনী। তখন নাকি বারণ করেছিলেন কাস্ত্রো। এ সব কথা সরিয়ে রেখেও শেষ পর্যন্ত চে গুয়েভারার ডায়েরি ফেরত শেষ কয়েকটা কথা মনে পড়ে। বলিভিয়ায় প্রবল বোমাবর্ষণ আর গুলির শব্দের মাঝে বসে দান্তে পড়তেন চে। কিউবার চিরবন্ধুকে গুয়েভারা লিখে যান, ‘ভুল বুঝোনা বন্ধু। তুমিই আমার পথপ্রদর্শক। কিউবার মানুষ আর তোমার জন্য আমার দুশ্চিন্তা থাকবে। আমার মৃত্যু যদি অন্য কোনও দেশে হয়, তাহলেও আমার শেষ ভাবনা থাকবে কিউবার জনগণ আর তোমাকে নিয়েই।’