অদ্ভুত সব নিয়মকানুন প্রচলিত আছে এবং অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটেছে এমন অনেক দেশের নাম করা যায়। তবে অদ্ভুত নিয়মকানুন এবং অদ্ভুত ঘটনার দিক থেকে উত্তর কোরিয়া অন্য সব দেশকে চোখের পলকে পেছনে ফেলে দেবে। বিশেষ করে দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট কিম জং-উনের ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে উন্মাদসুলভ কাহিনী ঘটেই যাচ্ছে।
একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রের যত বড় কর্তাই হোক, জনগণের সামনে সাধারণত দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলে। গোপনে বে-আইনি কাজ করলেও জনসম্মুখে সাধারণত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন যেন এসব কোনোকিছুরই তোয়াক্কা করে না। আর তার খেয়ালি সিদ্ধান্তের ফলে ভোগান্তিতে ভোগে দেশটির প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ। বলা যায় পৃথিবী নামক সাগরে আশ্চর্য এক দ্বীপ এই দেশটি, যেখানে পৃথিবীর কোনো আইন-কানুনের বালাই নেই। এই দেশটিকে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্নই বলা যায়। দেশটি মনে প্রাণে চাইছে অন্য কোনো দেশের সাহায্য ছাড়াই একা একা চলতে।
উত্তর কোরিয়ার এরকম কিছু দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো যেগুলো উত্তর কোরিয়া সবসময় গোপন রাখতে চায়।
উত্তর কোরিয়ায় ইন্টারনেট নিষিদ্ধ
এটা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট যে, উত্তর কোরিয়ায় ইন্টারনেট নিষিদ্ধ। পুরো একটি দেশে সামগ্রিকভাবে ইন্টারনেট নিষিদ্ধ হয়ে থাকবে এমনটা ভাবাই যায় না। কোনো কোনো দেশ থাকতে পারে বিশেষ কারণে বিশেষ কোনো ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করে রাখে। যেমন চীন ও রাশিয়ায় গুগল ও ফেসবুক নিষিদ্ধ। এর প্রধান কারণ হচ্ছে গুগল-ফেসবুকের বিকল্প হিসেবে তাদের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে কোনো দেশ কোনো ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করতে পারে। যেমন, প্রশ্ন ফাঁস রোধে বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক বন্ধ রেখেছিল। পরবর্তীতে আবার নিষেধাজ্ঞা তুলেও নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু উত্তর কোরিয়ায় আজব নিয়ম। দেশের অল্প কিছু মানুষ প্রতিদিন অল্প কয়েক ঘণ্টা করে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে মাত্র। তার উপর সরকার অনুমোদিত ১ হাজারটি ওয়েবসাইট বাদে অন্য কোথাও ভিজিট করতে পারে না সে দেশের নাগরিকরা। আর অনুমোদিত ১ হাজার ওয়েবসাইটগুলোও খুব একটা কাজের না। দেশের প্রেসিডেন্ট আজ কী করলো, কী খেলো, কোথায় গেলো, কী অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলো, কী বক্তব্য দিলো সেসব দিয়েই ভরা থাকে অনুমোদিত ওয়েবসাইটগুলো। তার উপর সমস্ত দেশে ইউনিক আইপি এড্রেস আছে মাত্র ১ হাজার। অথচ তার বিপরীতে মানুষ আছে প্রায় ২৫ মিলিয়ন।
নির্দিষ্ট ১০টি স্টাইলের বাইরে চুলের রাখতে পারবে না পুরুষেরা
অবাস্তব শোনাচ্ছে? হ্যাঁ, এটা সত্য যে উত্তর কোরিয়ার পুরুষেরা সরকার অনুমোদিত ১০টি স্টাইলের বাইরে চুলের কোনো স্টাইল ধারণ করতে পারবে না। পুরুষদেরকে কেন এই নিয়ম মেনে চলতে হবে তার কোনো সন্তোষজনক কারণ বা ব্যাখ্যা নেই। কারণ এটা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট কিম জং-উনের শাসন। তার অধীনে সবকিছুই সম্ভব। স্বৈরশাসক কিমের একটা ভয় যে, উত্তর কোরিয়ার মানুষ হয়তো কোনো একদিন আন্দোলন-অভ্যুত্থান করে তাকে অপসারণ করে ফেলবে। সেই ভয় থেকে অর্থহীন কিছু নিয়ম চাপিয়ে দিয়েছে মানুষের উপর। উদ্দেশ্য, এর মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা। কে কে আইন মানছে না তাদেরকে আগে থেকেই ধরে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। যারা ছোটখাটো এই নিয়ম অমান্য করবে তারাই পরবর্তীতে হয়ে যেতে পারে অভ্যুত্থানকারী। তাই আগে থেকেই সতর্কতা।
আর মেয়েরা? মেয়েদের জন্য চুলের স্টাইলও স্বাধীন নেই। তবে সংখ্যার দিক থেকে মেয়েদের জন্য স্টাইলের পরিমাণ বেশি। মেয়েরা মোট ১৮টি ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে চুল রাখতে পারবে। ২৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার জন্য সব মিলিয়ে ২৮টি হেয়ার কাট। এর বাইরে গেলে চলে যেতে হবে জেলখানায়।
চাচা এবং চাচীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট কিম
তার চাচার নাম জ্যাং সং-থিক। তিনি ছিলেন কিমের ব্যক্তিগত সহকারী। ২০১৩ সালে উত্তর কোরিয়া সরকার দাবী করে তার চাচা জ্যাং বিপ্লবের মাধ্যমে কিমকে অপসারণের পরিকল্পনার সাথে জড়িত। কিমের কাছে এই খবর যাবার পর তাৎক্ষণিকভাবে তাকে অপসারণ ও মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়।
কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ নয়। জ্যাং এর মৃত্যুতে তার স্ত্রী (কিমের চাচী) ব্যথিত ও মর্মাহত হয়। ব্যথিত হবার এই খবর পৌঁছায় প্রেসিডেন্ট কিমের কানে। সাথে সাথে চাচীকেও দেয়া হলো মৃত্যুদণ্ড।
প্রথম দিকে প্রচার হয়েছিল চাচার মৃত্যু সম্পন্ন করার জন্য কতগুলো ক্ষুধার্ত কুকুর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কুকুরগুলো দেহের মাংস ছিড়ে খেয়ে ফেলেছিল। তবে পরবর্তীতে কতগুলো নির্ভরযোগ্য সূত্র এটা নিশ্চিত করে যে চাচার মৃত্যু কুকুরের মাধ্যমে হয়নি। কিছু স্যাটায়ার পত্রিকা এমন প্রচার করেছিল।
১২ জন পপ তারকাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল কিম
পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত যেকোনো কিছুই উত্তর কোরিয়াতে বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এধরনের কাজে হাতেনাতে ধরা পড়লে নিশ্চিত দণ্ড। ২০১৩ সালে উত্তর কোরিয়া সরকার ১২ জন পপ তারকাকে আটক করে। তারকাদের অপরাধ হচ্ছে, তারা তাদের সঙ্গম মুহূর্তের ভিডিও টেপ তৈরি করেছিল। তারকারা খুবই বিখ্যাত ছিল এবং তারা উত্তর কোরিয়াকে অনেক ভালো কিছু উপহারও দিয়েছিল। কিন্তু অবদান ও খ্যাতি তাদের শাস্তিকে দমাতে পারেনি। শীঘ্রই তাদেরকে মেশিন গানের ফায়ারিংয়ে আনা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়, কিমের নির্দেশে তাদের নিকট আত্মীয়দেরকে ধরে লেবার ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়।
নীল রঙের জিন্স পরা নিষিদ্ধ উত্তর কোরিয়ায়
উত্তর কোরিয়াতে কোনোকিছু জনপ্রিয় হয়ে গেলে সেটা নিয়ে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায় প্রেসিডেন্ট কিমের। এটি থেকে এই বুঝি শুরু হয়ে গেল বিপ্লবের কর্মকাণ্ড! ২০১৪ সালে চকলেট পাই খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠে উত্তর কোরিয়ায়। এটি চিন্তায় ফেলে দেয় কিমকে। ভাবলেন নিষিদ্ধ করতে হবে এই বস্তুকে। যেই ভাবা সেই কাজ, হয়ে গেল নিষিদ্ধ। উত্তর কোরীয় কোনো নাগরিক এখন চকলেট পাই খেলে যেতে হবে চৌদ্দ শিকের ভেতর।
একই রকম আক্রোশ নীল রঙের জিন্স প্যান্টের প্রতিও। নীল রঙের জিন্স পরা যাবে না, কারণ এটি নাকি সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব করে।
পৃথিবীতে কিমই একমাত্র জেনারেল যার কোনো মিলিটারি অভিজ্ঞতা নেই
২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কিম জং-উন চার তারকা সমমান জেনারেল পদ লাভ করে। পরের দিন ২৮ সেপ্টেম্বর সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। উল্লেখ্য, সেনা সম্বন্ধীয় কোনো প্রকার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই এই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যায় কিম। সে সময়ে তখনো প্রেসিডেন্ট হয়নি সে। প্রেসিডেন্ট পদে আছে তার পিতা কিম জং-ইল। পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করতেই হয়তো এমন অনিয়ম করা হয়েছিল। এ থেকে অনুমান করা যায়, কতটা অনিয়ম পেঁচিয়ে রেখেছে উত্তর কোরিয়াকে।
পদক না জেতায় লেবার ক্যাম্পে যেতে হয়েছিল অলিম্পিক অ্যাথলেটদের
অলিম্পিক সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলো সাধারণত ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, সাম্য ও ঐক্যের নিদর্শন হিসেবে অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর সকল দেশ এরকম প্রতিযোগিতাকে এভাবেই দেখে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া এর ব্যতিক্রম। কিমের রাজত্বে উত্তর কোরিয়া থেকে কেউ অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করলে হয় জিতে আসতে হবে, নাহয় লেবার ক্যাম্পে পচে গলে মরতে হবে।
উত্তর কোরিয়ায় অলিম্পিক কমিটি আছে। ২০১৬ সালে ব্রাজিলের রিওতে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট কিম অলিম্পিক কমিটিকে নির্দেশ দিলেন উত্তর কোরিয়া যেন রিও অলিম্পিকে কমপক্ষে ৫টি স্বর্ণপদক ও ১২টি অন্যান্য পদক অর্জন করে। সে বছর বাছাই করে পাঠানো হলো মোট ৩১ জনকে। ৩১ জন মিলে ১৭টি পদক অর্জন করা অসাধ্য একটি কাজ। তারপরেও তারা দুটি স্বর্ণ এবং ৫টি অন্যান্য পদক অর্জন করে।
স্বাভাবিক মানুষের চোখে এটা জয় হলেও কিমের চোখে এটা পরাজয়। কিমের দেশকে যারা পরাজয় এনে দিয়েছে তাদের কপালে কী হয়েছে? কোনো এক লেবার ক্যাম্পে তারা এখনো দিন কাটাচ্ছে। খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে। যারা যারা পুরষ্কার অর্জন করতে পারেনি তারা তো সাজা পেয়েছেই, পাশাপাশি বলা হয়ে থাকে যারা পুরষ্কার পেয়েছে তাদেরকেও সাজা ভোগ করতে হচ্ছে। পুরো টিমের একসাথে জেলের ভাত খাওয়া।
উত্তর কোরিয়াতে এমন আজব ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ফিফা বিশ্বকাপ ২০১০-এ পর্তুগালের বিপক্ষে উত্তর কোরিয়া ৭-০ গোলে হেরে যায়। ঐ খেলায় অংশগ্রহণ করা কোরিয়ানদেরও গন্তব্য হয়েছিল লেবার ক্যাম্প।
উত্তর কোরিয়া সম্বন্ধে আরো কিছু অদ্ভুত তথ্য
তিন প্রজন্মব্যাপী শাস্তি
এমন অমানবিক নিয়ম সম্ভবত শুধুমাত্র উত্তর কোরিয়াতেই প্রচলিত আছে। দাদার অপরাধের জন্য নাতি-নাতনিদেরও শাস্তি ভোগ করতে হয়। কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধ করে তাহলে ক্ষেত্রবিশেষে তিন প্রজন্ম পর্যন্ত তার শাস্তি ভোগ করতে হয়। কেন? লেবার ক্যাম্পের লোকদের দিয়ে রাষ্ট্রের নিম্নশ্রেণীর কাজগুলো করানো হয়। ক্যাম্পে যদি লেবার না থাকে তাহলে সেসব কাজ কীভাবে করাবে? মানুষ তো আর ঝাঁকে ঝাঁকে অপরাধ করবে না। লোকবল দরকার, তাই তিন প্রজন্মব্যাপী এই ব্যবস্থা।
গাঁজা বৈধ উত্তর কোরিয়ায়
যে দেশে ইচ্ছেমতো চুল রাখা অবৈধ, ইচ্ছেমতো কাপড় পরিধান করা অবৈধ, ইন্টারনেট ব্যবহার করা অবৈধ, সে দেশে আবার গাঁজা বৈধ। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই গাঁজা অবৈধ। কিন্তু উত্তর কোরিয়া এই দিক থেকে বেশ দয়ালু। সৈন্য হতে আরম্ভ করে দেশের সকল স্তরের মানুষ বেশ উল্লাস করেই গাঁজা টানে। সে দেশে গাঁজা চা-সিগারেটের মতোই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, কিছু কিছু দেশে চিকিৎসার জন্য গাঁজাকে বৈধ বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু উত্তর কোরিয়া এখানে গাঁজাকে ওষুধ হিসেবে বিবেচনা করছে না। স্বাভাবিক হিসেবেই বৈধতা দিয়ে রেখেছে। প্রেসিডেন্ট কিম সম্ভবত ইচ্ছে করেই জাতিকে রসাতলে যেতে দিচ্ছে।