নিজস্ব প্রতিবেদক
চেঙ্গিস খানকে নিয়ে ইতিহাসে নানা বিতর্ক আছে। কারো কাছে চেঙ্গিজ_খান ছিলেন বিখ্যাত এক বিজেতা, কারো কাছে আবার মানবজাতির জন্য অভিশাপ, রক্তলোলুপ এক শাসক। শৈশবেই উপজাতীয় সরদার বাবাকে হারানোর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন তেমুজিন (চেঙ্গিজ খানের পূর্ব নাম)। কিন্তু এত অল্প বয়সী একটি ছেলেকে নেতা হিসেবে মেনে নিতে চায় নিজ নিজ গোত্রের সদস্যরা।
এভাবে দিন, মাস, বছর পার হতে থাকে। বাড়তে থাকে বালক তেমুজিনের বয়স। কৈশোরের শেষের দিকে তার শারীরিক গঠন, শৌর্যবীর্যের কাহিনী ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারদিকে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার অনুসারীর সংখ্যা। একবার বিরোধী এক গোত্র অপহরণ করে নিয়ে যায় যুবক তেমুজিনের স্ত্রীকে। ক্ষিপ্ত তেমুজিন লড়াই করেই ছিনিয়ে আনেন স্ত্রীকে।
এরপর আস্তে আস্তে যেন খোলস ছেড়ে বেরোতে থাকেন তেমুজিন। স্বপ্ন ছিলো আকাশ ছোঁয়ার। সেই শীর্ষস্থানে পৌঁছানোর পথ তৈরিতে এবার মনোযোগ দেন তিনি। বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত মঙ্গোল জাতিকে একত্রিত করে একটি সম্মিলিত শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চান তিনি। অনেক গোত্রই স্বেচ্ছায় তার বশ্যতা মেনে নেয়। যারা মানে নি, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বশ্যতা মানান। পরাজিত গোত্রগুলোর সামনে ছিলো দুটো রাস্তা- হয় চেঙ্গিজ খানের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া, নয় মৃত্যু।
১২০৬ সালে অবশেষে সুবিশাল মঙ্গোল সাম্রাজ্যের অধিপতি হিসেবে সবাই মেনে নেয় যুবক তেমুজিনকে। তার উপাধি হয় ‘চেঙ্গিজ খান’, অর্থ ‘বিশ্বজনীন শাসক’। আজ আমরা যত না তার আসল নাম ‘তেমুজিন’ জানি, তার চেয়েও বেশি জানি তার উপাধিটাকে।
তারপর শুরু হয় মঙ্গোলিয় বাহিনীর বিজয়াভিযান। ইউরেশিয়ার অধিকাংশ এলাকা চলে আসে মঙ্গোল বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তার জীবদ্দশায় ক্বারা খিতাই, ককেশাস, খারেজমিয়ান, পশ্চিম জিয়া ও জিন রাজবংশের বিরুদ্ধে লড়েছিল মঙ্গোল বাহিনী। এসব অভিযানে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। তার মৃত্যুর সময় মধ্য এশিয়া ও চীনের বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিলো মঙ্গোল সাম্রাজ্য।
১২২৭ সালের ১৮ আগস্ট দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন চেঙ্গিজ খান। কিন্তু তবুও যেন বিদায় নিলেন না এই খান! তার মৃত্যু যে ঠিক কীভাবে হয়েছিলো তা নিয়ে বিতর্কের কোনো অন্ত নেই। শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে চেঙ্গিজের মৃত্যুর যে বর্ণনা শুনতে পাওয়া যেত, তার সঙ্গে কোনো মিল ছিলো না শত্রুপক্ষের দেওয়া বর্ণনার। দুই পক্ষের বর্ণনা থেকে অন্তত এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, একপক্ষ চেয়েছিলো তার মৃত্যুকে মহিমান্বিত করে তুলতে, যেখানে অন্য পক্ষ চেয়েছিলো একই বিষয়কে কলঙ্কিত করে উপস্থাপন করতে। তাই ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া, যুদ্ধে মৃত্যুর কথা যেমন শোনা যায়, তেমনি তাঙ্গুত গোষ্ঠীর রাজকন্যার সম্ভ্রমহানি করতে গেলে সেই নারী তার জননাঙ্গ কেটে দেয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কথাও শোনা যায়।
চে্ঙ্গিজ খানের বিজয়াভিযান
মঙ্গোলরা তাদের অভি্যান পরিচালিত করত উষ্ণ মৌসুমে, এ সময় তাদের চলার পথে পশুদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য থাকত। যেহেতু ঘাসের ওপর ভিত্তি করে মঙ্গোল অভিযান পরিচালিত হত আর ঘাস জন্মানোর জন্য সুর্য অলো দরকার তাই তাদের সাম্রাজ্য ছিল সৌরশক্তি চালিত যেমন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল পালতোলা জাহাজ বা বায়ুশক্তি চালিত।
একজন ইতিহাসবিদের মতে যুদ্বে মঙ্গোলরা তাদের খর্বাকৃত দেহ কাঠামো, কদর্যতা, আর দূর্গন্ধ থেকে উদ্ভূত ত্রাস পুরোপুরি কাজে লাগাত। দৈহিক আকৃতির দিক দিয়ে মঙ্গোলরা ছিল খর্বাকৃতি, পাতলা কোমর, ছোট পা এবং বড় মাথা বিশিষ্ট। মাথার পেছনে আর ওপরে চুল ছেটে রাখত কিন্তু কানের পাশ দিয়ে লম্বা চুল থাকত।
প্রথা অনুযায়ী তাদের কাপড় ধোয়া নিষেধ ছিল। তাদের গায়ের দূর্গন্ধের অন্যতম কারন ছিল তাদের খাদ্য অভ্যাস।বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় তারা শুধু ঘোড়ার দুধ পান করত। যখন যুদ্বযাত্রায় থাকত তখন দুধ দোয়াবার সময়ের অভাবে চলন্ত অবস্থায় ঘোড়ার গলার রগ কেটে মুখ লাগিয়ে রক্তপান করত। রক্ত ঝরা অব্যাহত থাকলে তা তারা থলিতে জমিয়ে রাখত।
দীর্ঘ যাত্রাপথে ঘোড়ার জিনের নীচে তারা গোস্ত রেখে চলত যাতে তা চাপে নরম হয়ে যেত। পরে ধীরে ধীরে আয়েস করে খেত। টক দুধে ভেজানো রান্না করা ছুচো জাতীয় প্রানী খুব পছন্দ ছিল সেনাদের। ইদুর, বেড়াল, কুকুর, সাপ কোন কিছুই মঙ্গোল সেনাদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ যেত না।মঙ্গোলরা ঘোটকীর দুধ ফেনিয়ে কুমিস তৈরি করত, এই কুমিস তাদের খুব প্রিয় ছিল সাধারণত তারা যুদ্ব বন্দীদের পিঠে তক্তা বেধে তার ওপর বসে কুমিস পান করতে খুব পছন্দ করত। অতিরিক্ত কুমিস অনেক সময় তাদের মৃত্যুর কারন হত।
একজন ফ্রান্সিসকান ধর্মজাযক ১২৪৫ সালে প্রবল প্রতাপশালী খানের সঙ্গে দেখা করেন তাকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষা দেওয়ার বাসনায়। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, চীন দখলের সময় মঙ্গোলরা ভীষন খাদ্যাভাবে পড়ে তখন পর্যপ্ত বন্দী সঙ্গে না থাকায় প্রতি দশ জনে একজন সৈন্য তারা হত্যা করে খাদ্য হিসাবে। ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মঙ্গোলদের বিষয়ে ধারণা ছিল মঙ্গোলরা হলো কুকুরের মতো মস্তক বিশিষ্ট এক ধরনের প্রাণী।
মঙ্গোল যোদ্বাদের বর্ম ছিল লোহার পাতে তৈরি। পাতগুলো মোটা পশুর চামড়ায় পরিধেয়তে সূতা দিয়ে সেলাই করা হতো। তাদের শিরোনাস্ত্র ছিল সূচালো। তাদের তলোয়ার ছিল সূচালো আর বাকানো। তাদের তীরের গোড়ার খাঁজ ছিল খুবই সরু। এর ফলে প্রচলিত ধনুক দিয়ে এগুলো ছোঁড়া যেত না। এর মানে তাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট তীঁর তাদের দিকে শত্রুরা ফিরে পাঠাতে পারত না। তাদের ধনুকে ছিলা পড়াবার জন্য অন্তত দুজন মানুষ লাগত। মঙ্গোলদের অভিধানে ‘ডান’ বা বাম কথাটি ছিল না তারা ডান বাম বুঝাতে পূর্ব পশ্চিম সমার্থক শব্দ ব্যাবহার করত।
মঙ্গোল জাতির জনক ছিল চেঙ্গিজ খান। য়েসুকাই ছিলেন কিয়াদ গোত্রের প্রধান স্ত্রীর নাম হেলুন এদের প্রথম সন্তানের নাম তেমুজিন। ১১৬২ সালে ওনান নদীর তীরে একটি ছোট গ্রামে তেমুজিন জন্ম গ্রহন করে। এই তেমুজিন হল ইতিহাস প্রসিদ্ধ চেঙ্গিজ খান। কিংবদন্তি রয়েছে চেঙ্গিজ খান মুঠিতে রক্ত নিয়ে জন্মেছিলেন, যা মঙ্গোলিয়ার ঐতিহ্য অনুসারে ভবিষ্যত নেতা হওয়ার লক্ষণ।
শাসকের মতোই ছিল চেঙ্গিজের শৈশব। প্রথা অনুসারে মাত্র ৯ বছর বয়সে কুরতাইয়ের সঙ্গে বিয়েতে আবদ্ধ হন বাবার ইচ্ছায়। তাতার এবং মোঙ্গলিদের অন্তর্দ্বন্দ্বে চেঙ্গিসের পিতাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়। এ অবস্থায় গোত্রের প্রধান হিসেবে বাবার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বাসনা পোষণ করেন তিনি। কিন্তু অপরিণত বয়সের দোহাই দিয়ে তার গোত্র তাকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা চেঙ্গিজ এবং তার মা ও ভাই-বোনদের অরক্ষিত ফেলে রাখে। চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি এই পরিবারটি জীবনের সঙ্গে বুঝতে থাকে। এ সময় তিনি সৎ ভাইকে হত্যা করেন এবং জেলেও যান। মুক্ত হয়ে চেঙ্গিজ দেখতে পান রাজনৈতিক অনৈক্যে মঙ্গোল গোত্রগুলো লিপ্ত। চৌর্যবৃত্তি ও সন্ত্রাস এ সময় ছড়িয়ে পড়েছিল। এ সময় তিনি মায়ের কাছ থেকে ঐক্যের শিক্ষা লাভ করেন। যার ফসল আজকের মঙ্গোলিয় জাতি। তেমুজিনের প্রথম স্ত্রী বরটে মার্কিত গোত্র দ্বারা অপহরণ হয়।তেমুজিন তার বাবার বন্ধু তাঘ্রুল খানের সহায়তায় মার্কিতদের পরাজিত করে স্ত্রীকে উদ্ধার করেন।এইটা ছিলো ইতিহাসে তার প্রথম বিজয়।
১২০৬ সালে এক ঐতিহাসিক সম্মেলনে তিনি ‘ চেঙ্গিজ_খান’ (মহান) উপাধি গ্রহণ করেন। তার প্রচেষ্টার ফলে মোঙ্গল জাতি তৎকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে এবং ইতিহাসেও এক বিশেষ অধ্যায় সংযোজন করে।
নতুন উপাধি ধারণ এবং কারাকোরামে রাজধানী স্থাপনের পর (১২০৬ সালে) চেঙ্গিজ খান সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে আগ্রহী হন। দৃঢ় প্রত্যয় ও অসামান্য সাহসের অধিকারী চেঙ্গিস খান সমগ্র বিশ্বকে স্বীয় আধিপত্যে আনার স্বপ্নে উৎসাহিত হয়েছিলেন। এই সময় চীনদেশে কীন ও সাঙ নামে দু’টো পৃথক রাজবংশ রাজত্ব করতো। কীন রাজবংশের প্রতি চেঙ্গিজের দৃষ্টি সর্বপ্রথম নিপতিত হয়। এই রাজবংশের বিরুদ্ধে অভিযান চালনা করে তিনি পিকিংসহ অধিকাংশ স্থান স্বীয় সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি সাঙ বংশকেও ধ্বংস করে সেখানে মঙ্গোল আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন।
মুহম্মদ শাহ ছিলেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের একজন শক্তিশালী সুলতান। প্রথমদিকে চেঙ্গিজ খানের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব থাকলেও পরবর্তীকালে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির ফলে উভয়ের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ দেখা দেয়। ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সীমান্ত বিরোধ ছাড়াও আরও দুটো কারণ চেঙ্গিজ খানকে মুহম্মদ শাহের রাজ্য আক্রমণে প্ররোচিত করেছিল। প্রথমত, চেঙ্গিজ খানের প্রেরিত উপঢৌকনসহ তার দূত মুহম্মদ শাহের দরবারে আগমন করলে মুহম্মদ শাহ এর রাজনৈতিক অর্থ অনুধাবন করে দূতকে প্রত্যাখ্যান করেন। দ্বিতীয়ত, ওতবা নামক স্থানে মুহম্মদ শাহের নির্দেশে কিছুসংখ্যক মঙ্গোল বনিক নিহত হলে চেঙ্গিজ এর ক্ষতিপূরণ দাবি করেন এবং ওতবার গভর্ণরকে তার কাছে আত্মসমর্পনের আদেশ দেন। মুহাম্মদ শাহ এতে অসম্মত হলে চেঙ্গিজ খান তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন (১২১৯ সালে)। যুদ্ধে মুহম্মদ শাহ পরাজিত হলে ওতবা এবং বোখারা, হিরাত, বলখ, খোজান্দ, তাসখন্দ, সমরকন্দ প্রভৃতি মোঙ্গল শাসনাধীনে আসে। এসব অঞ্চলের মঙ্গোলদের নির্মম ধ্বংসলীলা সম্বন্ধে ঐতিহাসিক গীবন মন্তব্য করেন, ‘এই চার বছরের মধ্যে যে ধ্বংসসাধিত হয়, তা পাঁচশ বছরেও পুনর্গঠন করা সম্ভব হয় নি।’
১২২০ সালে মুহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র জালাল উদ্দিন শাহ পিতৃসাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। মঙ্গোল জাতিকে কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত করতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়ে ভারতবর্ষে পলায়ন করেন।
চেঙ্গিজ খান ১২২২ সালে আফগানিস্তানের হেরাতে শুধু তীর, মুগুর আর খাটো তলোয়ার দিয়ে ১৬ লাখ মানুষ হত্যা করে। নগর আর কৃষি ভূমির জন্য সে সময় মঙ্গোলরা ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মঙ্গোলদের আদি নিবাস মধ্য এশিয়ার ঘেষো স্তেপ ভূমি। তাদের আগে হুন আর স্কিথীয় হানাদারদের উদ্ভব এই অঞ্চল থেকে। ভূপ্রকৃতির কারনে এ অঞ্চলে উন্নত ঘোড়া পাওয়া যেত, আর বিরূপ পরিবেশ তাদের করেছে দুর্ধর্ষ। সব মিলিয়ে চৌকম যোদ্ধা আর নৃশংস খুনী।
চেঙ্গিজ খানের অমিমাংসিত মৃত্যু
চেঙ্গিজ খানের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল সেটা আজো অমিংমাসিত। এনিয়ে নানা মত পাওয়া যায়। যেসব মত পাওয়া যায় সেসব বিষয় নিচে তুলে ধরা হল।
খোজাকরণের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু
চীনে একটি বিদ্রোহ দমন করতে ১২২৬ সালে পারস্য থেকে চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন চেঙ্গিসজ খান। জিয়া ও জিন রাজবংশকে এক দশক আগেই তিনি পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু খানের অনুপস্থিতির সুযোগে স্বাধীনতার নেশা তাদের মাঝে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলো। মঙ্গোল বাহিনী তাদের শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হয়। ১২২৭ সালে জিয়া রাজবংশের অধিকাংশ (তাঙ্গুত বংশধারা) সদস্যকেই হত্যা করতে সক্ষম হয় মঙ্গোল বাহিনী। পরবর্তীতে যাতে আর কোনো বিদ্রোহী মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্যই বেছে নেয়া হয়েছিলো নির্মম এ হত্যাকান্ডের পথটি।
এখন যে কাহিনীটি বলতে যাচ্ছি সেটি মঙ্গোলীয় গোত্রগুলোর মুখে ঘুরে বেড়ায়। এক রাতে চেঙ্গিস খান স্বপ্নে দেখলেন যে, শুভ্র তুষারের উপর পড়ে আছে কারো তাজা লাল রক্ত। এমন স্বপ্ন দেখে স্বাভাবিকভাবেই তিনি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। পরদিন আবার তাঙ্গুতদের সর্বশেষ বিদ্রোহী যুবরাজের সাথে যুদ্ধ ছিলো মঙ্গোলদের। দ্য গ্রেট খান তাই আর দেরি না করে চলে গেলেন পুরোহিতদের কাছে, জানতে চাইলেন স্বপ্নের ব্যাখ্যা। উত্তরে তারা জানালেন যে, রক্তের ধারাটি সেই তাঙ্গুত যুবরাজের যে কিনা যুদ্ধে নিহত হবে। আর শুভ্র তুষার দিয়ে বোঝানো হয়েছে যুবরাজের অপরুপা কন্যাকে যে কিনা তার কাছে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসা সবাইকেই ফিরিয়ে দিয়েছে।
পরদিন যুদ্ধে সেই তাঙ্গুত যুবরাজকে হত্যা করে তার সুন্দরী মেয়েটিকে নিজের শয়নকক্ষে নিয়ে যান চেঙ্গিস খান। যখন তিনি মেয়েটির সম্ভ্রমহানীর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন, তখনই মেয়েটি মারাত্মক সাহসের পরিচয় দিয়ে বসে। খোঁপার আড়ালে লুকনো ছোট্ট একটি ছোরা বের করে খানের জননাঙ্গ কেটে দেয় সে! এরপর আর মেয়েটি সেখানে অপেক্ষা করে নি। শারীরিক লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচতে দ্রুত পালিয়ে যায় সে, ঝাঁপ দেয় পাশেই থাকা হলুদ নদীতে। এরপর থেকেই তার সম্মানার্থে নদীটির নাম দেয়া হয় ‘রাজকন্যার নদী (খাতুন গল)’।
এখন প্রশ্ন হলো- এ কাহিনী আসলে কতটা সত্য? এমন একটি ঘটনা চেঙ্গিস খানের জীবনের শেষ মুহূর্তকে স্বাভাবিকভাবেই কলঙ্কিত করে তোলে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, চেঙ্গিস খানের মৃত্যুকে নোংরাভাবে দেখানো এ কাহিনীর প্রবক্তা ঐরাত গোত্র। ‘পশ্চিমা মঙ্গোল’ নামে পরিচিত ঐরাতরা আজীবনই চেঙ্গিসের ‘পূর্ব মঙ্গোল’দের শত্রু ছিলো। খোজাকরণের মাধ্যমে চেঙ্গিসের মৃত্যুর এ কাহিনীটির উদ্ভব ঘটে সতের শতকে। তখনকার সময়ে মঙ্গোল গোত্রগুলোর মাঝে দাঙ্গা চলছিলো। ফলে অধিকাংশ ইতিহাসবিদই কাহিনীটিকে মিথ্যে বলে সাব্যস্ত করেছেন।
যুদ্ধরত অবস্থায় মৃত্যুঃ হাইপেশিয়ান কোডেক্স অনুসারে ১২২৭ সালে চীনাদের বিরুদ্ধে জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধেই নিহত হয়েছিলেন চেঙ্গিস খান। ১৪২৫ সালে লিখিত এ কোডেক্সটি বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ান ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে রাখা আছে।
মার্কো পোলোর বর্ণনানুযায়ী, কাজু নামক এক দুর্গের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে যুদ্ধরত অবস্থায় হাঁটুতে তীর বিদ্ধ হন চেঙ্গিস। পরবর্তীতে এ আঘাতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুঃ ‘Secret History of the Mongols’ নামক মঙ্গোল সাম্রাজ্যের ঘটনাপঞ্জীতে উল্লেখ করা আছে যে, ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েই মৃত্যু হয়েছিলো চেঙ্গিস খানের।
বইটির বর্ণনানুযায়ী চেঙ্গিজ তার লোকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঙ্গুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রার প্রস্তুতি নিতে। তিনি সেই সময় দক্ষিণ মঙ্গোলিয়ায় শীত আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন এবং বন্য ঘোড়া শিকার করে সময় পার করছিলেন। একদিন দুর্ঘটনাবশত শিকাররত অবস্থায় ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে বেশ আহত হন ৬৫ বছর বয়সী চেঙ্গিজ খান। একদিকে শীত সহ্য করতে না পেরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া, অন্যদিকে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মক আহত হওয়া- দুটোই মারাত্মক কাবু করে ফেলেছিলো মঙ্গোল অধিপতিকে। এই অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন চেঙ্গিজ খান।
এখন প্রশ্ন হলো- এই বর্ণনাই বা কতটুকু সঠিক? ‘Secret History of the Mongols’ লেখা হয়েছিলো ১২৪০ সালে। বলা হয়ে থাকে যে, চেঙ্গিসের এক পালক পুত্রের বর্ণনার উপর ভিত্তি করেই বইটি লেখা। এজন্য উপরোক্ত তিনটি সম্ভাব্যতার মাঝে এটিই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
মৃত্যুর পরও যখন মৃত্যুর কারণ চেঙ্গিজ খান
নিজের মৃত্যুশয্যায় চেঙ্গিজ খান ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, জি জিয়া রাজ্যটিকে যেন পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দেওয়া হয়। তার নির্দেশটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলো অনুগত বংশধরেরা। শহরটিকে একেবারে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলো তারা। নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয় নিরপরাধ জনগণের ওপর, ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয় আরো অনেককেই।
চেঙ্গিজ খান চেয়েছিলেন তার কবরটি যেন কেউ কোনোদিন খুঁজে না পায়। তার সেই নির্দেশটিও ঠিকমতোই পালন করেছিলো মঙ্গোল বাহিনী। তার মৃতদেহবাহী সেই দলটির চীন থেকে মঙ্গোলিয়া আসতে সপ্তাহখানেক সময় লেগেছিলো। কথিত আছে যে, দীর্ঘ এ যাত্রাপথে যে ব্যক্তিই দলটির সামনে পড়েছিলো, তাকেই হত্যা করেছিলো মঙ্গোল সেনারা। সমাধিস্তম্ভটি বানানো শেষ হলে যারা সেটি বানিয়েছিলো, তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। এরপর সেখানে থাকা সৈন্যরাও আত্মহত্যা করে!
চেঙ্গিজ খানের কবরটির সঠিক অবস্থান গোপন করার জন্য তার আজ্ঞাধীন সৈন্যরা যে অনেক চেষ্টা করেছিলো সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু সেই চেষ্টার মাত্রা ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিলো, সেই সম্পর্কে কোনো সঠিক বর্ণনা দেয়ারও উপায় নেই। এজন্যই বিষয়টি নিয়ে গড়ে উঠেছে নানা কিংবদন্তী।
কথিত আছে, কবরটি লুকিয়ে ফেলার জন্য নাকি একটি নদীর গতিপথই পাল্টে দিয়েছিলো মঙ্গোল বাহিনী। তারা নদীটিকে কবরের উপর দিয়ে প্রবাহিত করেছিলো যাতে কেউ তা খুঁজে না পায়। এক বর্ণনায় আছে, কবরটির উপর দিয়ে চালনা করা হয়েছিলো অসংখ্য ঘোড়া। এরপর সেখানে লাগিয়ে দেয়া হয় একটি গাছ। পাশাপাশি তুষারপাতের ফলে একসময় কবরটি চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। আরেকটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, খানের মৃত্যুর ৩০ বছর পর কবরটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো। চেঙ্গিস খানের সাথে একটি বাচ্চা উটকেও কবর দেয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে বাচ্চাটির মাকে সেই জায়গায় গিয়ে কাঁদতে দেখা গিয়েছিলো।
চেঙ্গিজ খান বলেছিলেন, কবরে যেন তার ছয়টি বিড়ালকেও সঙ্গে দিয়ে দেয়া হয়, যাতে বিড়ালগুলোর ডাক শুনেই পরকালে তিনি মঙ্গোলিয়ায় পৌঁছাতে পারেন। মৃত্যুর পর তার সঙ্গে ৪০ জন ‘চাঁদের মতো সুন্দরী’ কুমারী নারীকেও খুন করে কবর দেওয়া হয়েছিলো, যেন পরজীবনে তারা তাকে সঙ্গ দিতে পারে! অবশ্য এ দাবির সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের উপায় নেই আজ। খানের মৃত্যুর প্রায় ৬০ বছর পর মঙ্গোলিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন মার্কো পোলো। তিনিই এই কাহিনীটি জানিয়েছিলেন। বিড়াল ও কুমারীর পাশাপাশি অজস্র ধনরত্নও দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো চেঙ্গিজের কবরে।