বাংলাদেশেও এবার ইলেক্টোরাল ভোট!

নভেম্বর ২২, ২০১৬
Spread the love

আয়না২৪ প্রতিবেদন

আমেরিকার সদ্য সমাপাপ্ত পেসিডেন্ট নির্বাচনে  সাধারণ ভোটারদের  ভোট বেশি পেয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। কিন্তু ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট বেশি পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হয়েছেন  ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গণরায়ের পাশাপাশি নির্বাচকমণ্ডলী (ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট) থাকার প্রদ্ধতি  নিয়ে  এবার প্রশ্ন  তুলেছেন  দেশটির নাগরিকেরা।  নির্বাচনের এই  পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে সম্প্রতি কিছু  বিক্ষোভও হয়েছে সেখানে।

আমেরিকার  এই ভোট গ্রহণ পদ্ধতির আদলে এবার বাংলাদেশেও ৬১ টি জেলা পরিষদে আগামী ২৮ ডিসেম্বর  ভোট হবে   নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট)  মাধ্যমে। এখানে অবশ্য একই সঙ্গে সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে পারছেন না। কেবল স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন  স্তরে জনপ্রতিনিধিগণ ( চেয়ারম্যান-মেম্বার-মেয়র-কাউন্সিলর)   জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচন করবেন।
এদিকে নির্বাচনের এই পদ্ধতি  দেশের সংবিধানের চেতনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ- এই দাবি তুলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যাদের আপত্তি আছে, তারা আইন সংশোধনের দাবি করে উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিতে পারে। কারণ সংবিধান পরিপন্থী কোনো বিষয় থাকলে আদালত অবশ্যই তা আমলে নিবে।

গত  ১৭ নভেম্বর রাতে গণমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, যে প্রক্রিয়ায় এই নির্বাচন হচ্ছে তা সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী। কারণ পরোক্ষ ভোট সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী।

সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ সামনে আনছেন পরোক্ষ নির্বাচনের বিরোধী পক্ষ। তবে দেশের সংবিধানে পরোক্ষ ভোটের বিপক্ষে সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সংবিধানের ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ বিষয়ক ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে হইবে।’’ অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনই বড়ো কথা, প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ ভোট সেটা কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে আগের মেয়াদে থাকা জেলা পরিষদের অনির্বাচিত প্রশাসকদের সাংবিধানিক বৈধতার বিষয়টি প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়।

জেলা পরিষদ নির্বাচনের বর্তমান আইন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেছেন, আইন নিয়ে কারো আপত্তি থাকলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। কারণ এমন অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো সরকার চেয়েছিলো, কিন্তু সংবিধান পরিপন্থী বলে পরে আদালত বাতিল করে দিয়েছে। তবে জেলা পরিষদ নির্বাচনে সরাসরি ভোট হলে সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের মর্যাদা নিয়ে এক ধরনের টানাপড়েন তৈরির ঝুঁকি আছে বলে তিনি মনে করেন।

ভোটার কারা, প্রার্থী কারা

২৫ বছর বয়সী বাংলাদেশের যে কোনো ভোটার জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারলেও ভোট দিতে পারবেন না। আর জনপ্রতিনিধিরা ভোটার হলেও প্রার্থী হতে পারবেন না। প্রার্থী হতে হলে তাদের পদ ছাড়তে হবে।

জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, সদস্য, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর, মহিলা সদস্য জেলা পরিষদের নির্বাচনম-লীর সদস্য বা ভোটার হবেন।

এ বিষয়ে বিদ্যমান আইনের ১৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক জেলার অন্তর্ভুক্ত সিটি করপোরেশনের (যদি থাকে) মেয়র ও সব কমিশনার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সব কমিশনার এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সব সদস্যের সমন্বয়ে জেলার পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হবে।’ তবে উপজেলা পরিষদে দু’জন করে ভাইস-চেয়ারম্যান থাকলেও আইনটি প্রণয়নের সময় এ পদ দু’টি উপজেলা পরিষদ আইনে না থাকায় নির্বাচকমণ্ডলীতে তাদের উল্লেখ নেই। এক্ষেত্রে আইন সংশোধন করে এটা অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানা গেছে।

এদিকে আইনে নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর/সদস্যের নাম স্পষ্ট করে বলা না থাকলেও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ মনে করছেন সদস্য বলতে দুই ধরনের সদস্যকেই বোঝানো হয়েছে।

ইলেক্টোরাল কলেজ কী?

আমজনতার বদলে তাদের ভোটে নির্বাচিত বা নির্ধারিত জনপ্রতিনিধিরা যখন অন্য কোনো স্তরের পরিষদে প্রতিনিধি নির্বাচন করার ভোটার হন, নিচের ধাপের সেই জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচকমণ্ডলী বা ইলেক্টোরাল কলেজ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করে মোট ৫৩৮ জন ‘ইলেক্টর’ বা নির্বাচকের ভোটের ওপর। প্রতিটি রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে এসব নির্বাচকের সংখ্যা নির্ধারিত থাকে। যেমন, জনবহুল ক্যালিফোর্নিয়ার রয়েছে ৫৫ জন নির্বাচক, আবার বিরল জনসংখ্যার মন্টানার রয়েছে মাত্র তিনটি ভোট। জিততে হলে প্রয়োজন ন্যূনতম ২৭০ ইলেক্টোরাল ভোট। একটি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ‘জনপ্রিয় ভোট’ যিনি পাবেন, সে রাজ্যের নির্ধারিত সব ইলেক্টোরাল ভোট তাঁর খাতায়ই জমা হবে। এ কারণে মোট ভোটের হিসাবে এগিয়ে থেকেও কোনো প্রার্থী পর্যাপ্ত ইলেক্টোরাল ভোট পেতে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন না।

প্রত্যক্ষ ভোটের পক্ষে বদিউল

জেলা পরিষদ নির্বাচন সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে হলে ভালো হতো বলে মনে করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি  বলেন, ‘যে আইনের মাধ্যমে নির্বাচন হবে, তা সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ সংবিধানে প্রত্যক্ষ ভোটের উপর জোর দেয়া হয়েছে।’

বিএনপি নির্বাচনে প্রার্থী সমর্থনে আগ্রহী হলে ভালো হতো বলে মনে করছেন সুজনের সম্পাদক। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, তৃণমূলে সরকারি দলের জনপ্রতিনিধি বেশি থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হয়তো বিএনপি দূরে আছে। এ নির্বাচনে সরকারি দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি থাকবে। পরোক্ষ ভোটে ভোটার সংখ্যা কম থাকায় জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট বেচাকেনার ঝুঁকি বেশি বলে মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার।

চেয়ারম্যান এক, সদস্য ২০

আইন অনুযায়ী, প্রতিটি জেলায় স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের ভোটেই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচিত হবেন। প্রতিটি জেলায় ১৫ জন সাধারণ ও পাঁচজন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য থাকবেন। সাধারণ সদস্য নির্বাচনের জন্য প্রত্যেকটি জেলাকে ১৫টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হবে এবং সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের জন্য হবে ৫টি ওয়ার্ড।

পদ ছাড়তে হবে প্রশাসকদের

জেলা পরিষদ নির্বাচন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে বর্তমান প্রশাসকদের প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতার বিষয়ে নতুন বিধি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।  জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইলে একজন প্রশাসককে আগে পদত্যাগ করতে হবে। এই বিধি যোগ করে সংশোধনী আনা হয়েছে স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনে।

নির্বাচন ২৮ ডিসেম্বর

দেশে প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য ২৮ ডিসেম্বর দিন ঠিক করে দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে চিঠি পাঠিয়ে ভোটের ওই তারিখ ইতিমধ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় নির্বাচনী বিধি ও আচরণ বিধি গেজেট আকারে প্রকাশ করে তফশিল ঘোষণার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। নির্বাচন কমিশনও চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। নির্বাচনী বিধি ও আচরণ বিধির গেজেট আকারে প্রকাশের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে তারা জানিয়েছে।

পরিষদের ইতিবৃত্ত

তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের ৬১ জেলা পরিষদে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার। তাদের মেয়াদপূর্তিতে জেলা পরিষদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে চলতি বছরের ২৮ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে অনুমোদন ও কার্যকর হওয়া বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ ইতিমধ্যে আইনের দ্বারা ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদকে প্রশাসনিক ইউনিট ঘোষণা করা হয়েছে। পৌরসভা/ সিটি করপোরেশনও এর অন্তর্ভুক্ত।

পরে নির্বাচনের বিধান রেখে প্রতিটি ইউনিটের জন্য আলাদা আলাদা আইন করা হয়। এই আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও হয়েছে। কিন্তু জেলা পরিষদ নিয়ে টালবাহানা চলে আসছে।

স্বাধীনতার পর প্রথম ১৯৮৮ সালে জেলা পরিষদগুলোতে  চেয়ারম্যান হিসেবে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয় সংসদ সদস্যদের। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের নিয়োগ বাতিল করা হয়। তখন থেকে একজন সরকারি কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে চলছিল জেলা পরিষদ। দীর্ঘ দুই দশক পর জেলা পরিষদ আবার আমলার শাসনের বাইরে আসে।