আয়না ২৪ প্রতিনিধি
সিলেটে জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহলে’ অপারেশন ‘টোয়ালাইট’ চালাচ্ছে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো। শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সেনা বাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনোয়ারুল মোমেনের নেতৃত্ব এ অভিযান শুরু হয়েছে।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এক সংক্ষিপ্ত প্রেসব্রিফিংয়ের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। ৩০ টি গাড়ি ও চারটি সাজোয়া যান নিয়ে ঘটনাস্থলে রয়েছে সেনাবাহিনী।
সকালে পুলিশের পক্ষ থেকে জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহলে’ অপরেশন ‘স্প্রিং রেইন’ নামে অভিযান শুরুর কথা বলা হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনী এ নাম পরিবর্তন করে অপারেশন ‘টোয়ালাইট’ রেখেছে।
এর আগে সকাল ৮টায় ঘটনাস্থলের আশপাশে উপস্থিত সাংবাদিকসহ উৎসুক জনতাকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে সরিয়ে দেয়া হয়।
এদিকে, জঙ্গি আস্তানার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছেছেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। শনিবার রাত সোয়া ৩টার পর একটি সাদা রংয়ের গাড়িতে করে তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছান।
সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়ায় ‘জঙ্গি আস্তানা’ সন্দেহে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটা থেকে ‘আতিয়া মহল’ নামের পাঁচতলা একটি বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ। এর আগে ওই এলাকায় ব্লক রেইড করে আস্তানাটি চিহ্নিত করা হয়। এসময় পুলিশ ভবনে জঙ্গিদের কক্ষের দরজা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়।
বাড়ির নিচতলার ফ্ল্যাটের পূর্বদিকের উত্তর কোণের একটি কক্ষে জঙ্গিরা অবস্থান করছে বলে ধারণা পুলিশের। সকালে ঘটনাস্থলের পাশের ভবন থেকে কমপক্ষে ৭০ জনকে নিরাপদে সরিয়ে নেয় পুলিশ।
ঘিরে ফেলার পর পুলিশের বারবার আহ্বানের পরও আত্মসমর্পণে জঙ্গিরা সাড়া না দেয়ায় সোয়াট সদস্যদের সঙ্গে অভিযানে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যদের তলব করা হয়। প্যারা কমান্ডো ইউনিট ও সোয়াট সদস্যরা বাসার ভেতরে ও চারপাশে অবস্থান নিয়েছেন। অভিযান চালাতে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে যৌথ বাহিনী। বাড়ানো হয়েছে পুলিশের সংখ্যা।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে সিলেট নগরের উপকণ্ঠ টিলাগড়ের শাপলাবাগ এলাকার ‘সূর্যদীঘল’ বাড়ি থেকে জেএমবির তৎকালীন আমির শায়খ আবদুর রহমানকে অনেক নাটকীয়তার পর গ্রেফতার করেছিল র্যাব।শ্বাসরুদ্ধ অপেক্ষা।
চারদিকে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। সবার মাঝে অজানা শঙ্কা। এরই মধ্যে গ্রেনেড বিস্ফোরণ, গোলাগুলি। সময়ের সঙ্গে বাড়ছে উত্তেজনার পারদ। ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছে সোয়াত টিম। যোগ দিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম টিমের সদস্যরা। দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা বন্দি সিলেটের আতিয়ার ভিলার বাসিন্দারা। যেখানে রয়েছে জঙ্গি আস্তানা।
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আতিয়ার ভিলা ঘিরে ফেলে পুলিশ। এ ভিলার নিচতলার জঙ্গি আস্তানাকে ঘিরে গোটা সিলেট নগরীতে এখন টান টান উত্তেজনা। কি হয়, কি হচ্ছে- এমন প্রশ্ন সবার মনে। এ অবস্থায় রাত পৌনে ন’টায় উপস্থিত হন সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যরা।
রাত তখন সাড়ে তিনটা। গোটা সিলেট শহর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওই সময় দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকায় অভিযান শুরু করে ঢাকা থেকে আসা কাউন্টার টেররিজম টিমের সদস্যরা। তল্লাশি করতে করতে আতিয়ার ভিলাতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় তারা। ৫ তলা ওই ভবনের নিচতলায় জঙ্গি রয়েছে নিশ্চিত হওয়ার পর ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ করে দেয়। পরে বাসার ফটকেও তালা দেয়। একই সঙ্গে পাশের চারতলা ভবনে জঙ্গি থাকার ব্যাপারে সন্দেহ করে কাউন্টার টেররিজম দলের সদস্যরা। তারা ওই বাসাও তালাবদ্ধ করে দেয়। পরে সিলেট মহানগর পুলিশ ভোররাত থেকেই আতিয়ার ভিলাসহ দু’টি ভবন ঘেরাও করে রাখে। ভোরের দিকে পুলিশ ওই ভবনে ঢুকতে চাইলে জঙ্গিরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে পুলিশকে লক্ষ্য করে পরপর কয়েকটি গ্রেনেড ও গুলিবর্ষণ করে। পুলিশও কয়েকরাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ সময় গুলি ও গ্রেনেডের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। ভোরে গ্রেনেড ও গুলির শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
এ সময় শিববাড়ী থেকে পাঠানপাড়া রাস্তাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। পুলিশ আতিয়ার ভিলাকে ঘিরে চার স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে। মূল রাস্তার প্রবেশ পথে দেয়া হয় ব্যারিকেড। আর আতিয়ার ভিলার একটু দূরে আরেকটি ব্যারিকেড দেয়। পিছন দিক থেকে পুলিশ স্কুলের সামনে ব্যারিকেড বসায়। আতিয়ার ভিলার ঠিক পেছনের অংশেও দেয়া হয় ব্যারিকেড। ফলে চারদিকে অবরুদ্ধ থাকায় পুরো ৫ তলা বিশিষ্ট আতিয়ার ভবন ও পাশের চারতলা ভবনের সব পথই রুদ্ধ করে দেয়। ওদিকে থেমে থেমে চলছিল গুলিবিনিময়। কখনো ঘরের ভেতর থেকে আবার কখনো পুলিশ ছুড়ছিল। দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ১৫ মিনিট পরপর গুলির শব্দ শোনা যায়। এ সময় পুলিশ পাশের ভবনের ছাদ, দেয়ালের কর্নার, পিছন দিকের দেয়ালের নিচের অংশে পজিশন নিয়ে বসে থাকে। সকাল ১০ টার দিকে ঘটনাস্থলে যান সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া, ডিআইজি কামরুল আহসান, অতিরিক্ত কমিশনার রোকনউদ্দিন, সিলেটের পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামানসহ সিলেট পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া।
তিনি বলেন- পুলিশ আতিয়ার ভিলা ঘিরে রেখেছে। ভেতরে অনেকেই রয়েছেন। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে অভিযান চালানো হচ্ছে না। তিনি বলেন- ঢাকার কাউন্টার টেররিজম দলের সদস্যদের তথ্যের ভিত্তিতে ওই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মিলে। এখানে দুইজন পুরুষ ও একজন মহিলা রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। কাউন্টার টেররিজম টিমের এক সদস্য জানিয়েছেন- চট্টগ্রামসহ অন্যান্য এলাকা থেকে আটক জঙ্গিদের তথ্যের ভিত্তিতে এখানে অভিযান চালানো হয়। তারা খবর পান মর্জিনার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল সিলেটে অবস্থান করছে। পরে তারা মর্জিনার নামে কোড ব্যবহার করে ডিভাইসের মাধ্যমে নিশ্চিত হন। এরপর তারা অভিযান শুরু করেন। কিন্তু অভিযানের সময় তাদের লক্ষ্য করে গুলি ও গ্রেনেড ছোড়া হয়। তিনি বলেন- আতিয়ার ভিলার ওই কক্ষে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরক রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ কারণে সকল প্রস্তুতি নিয়েই অভিযান পরিচালনা করা হবে। সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের শিববাড়ী পয়েন্টের দুই গজের মধ্যেই এই ভবনের অবস্থান। আতিয়ার ভিলায় রয়েছে মোট ৩০টি ফ্ল্যাট। পাশে রয়েছে ৪ তলা ভবন।
ওই ভবনে রয়েছে ১০টি ফ্ল্যাট। দু’টি ভবনের মালিক হচ্ছেন স্থানীয় উস্তার মিয়া। সিলেটে উস্তার মিয়ার রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। নগরীর উপ-শহরেও রয়েছে তার বাসা। উস্তার মিয়া তার মালিকানাধীন প্রতিটি ভবনেই ফ্ল্যাট নির্মাণ করে ভাড়া দেন। উস্তার মিয়ার বাসায় জঙ্গি আস্তানার খবর রটার পর তিনি নিজেও ছুটে যান ওখানে। তিনিও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। উস্তার মিয়া পরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- তার মালিকানাধীন ৫ম তলা বাসায় রয়েছে মোট ৩০টি ফ্ল্যাট। এর মধ্যে নিচতলার একটি ফ্ল্যাট গত জানুয়ারি মাসে ভাড়া নেয় মর্জিনা নামের এক মহিলা। ওই মহিলার স্বামীর নাম কাওছার আলী। ভাড়া নেয়ার সময় মর্জিনা তার স্বামীকে ‘প্রাণ’ কোম্পানির কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। উস্তার জানান- ভাড়া নেয়ার সময় তিনি যথাযথ নিয়ম মেনেই বাসা ভাড়া দিয়েছেন। তারা প্রতি মাসে ভাড়াও দিয়েছে। এরা যে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত সেটি তারা বুঝতে পারেননি। উস্তার মিয়ার ছেলে কাওছার আহমদ রিপন জানিয়েছেন- ভাড়া দেয়ার সময় আমরা তাদের সন্দেহ করতে পারিনি। এছাড়া তাদের আইডি কার্ড রেখে দিয়েছিলাম।
এদিকে- অভিযান সম্পর্কে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গণমাধ্যম) জেদান আল মুছা মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘রাতে জঙ্গি সন্দেহে প্রথমে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এরপর পুলিশ বাধার মুখে পড়ে। পড়ে যখন বাড়ির মালিকের কাছ থেকে তাদের ছবি দেখলাম তখন পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম যাদের খুঁজছিলাম তারা এখানে রয়েছে।’ তিনি বলেন- ওরা পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ও গুলি ছুড়েছে। এদিকে- সকালের দিকে বোমা ও গুলির শব্দের পর পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ আতিয়ার ভিলার আশপাশের সব ভবনের বাসিন্দাদের সরিয়ে দেয়। এছাড়া সামনের দোকানপাটও খোলা হয়নি।
পুলিশ কর্মকর্তা জেদান আল মুছা জানিয়েছেন- সকাল ৯ টার দিকে তারা অন্তত ৩০ জনকে ওই বাসার ১০টি ফ্ল্যাট থেকে বের করে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে শিশুদের পুলিশ কর্মকর্তারা গিয়ে নিয়ে আসেন। তাদের নিরাপদে উদ্ধারের পর পেছনের স্কুলে নিয়ে রাখা হয়। তবে আতিয়ার ভিলার কাউকে তারা উদ্ধার করতে পারেননি। ওই বাসায় ৫ তলায় শতাধিক লোক আটকা রয়েছেন। দিনভর তারা কেবল মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
দুপুরের দিকে মাইক নিয়ে আতিয়ার ভিলার পাশে যান এক সাব-ইন্সপেক্টর। তিনি ওই সময় হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলেন- ‘আপনারা এসে আত্মসমর্পণ করুন।’ এতে কোনো সাড়া মেলেনি। একপর্যায়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন- ‘মর্জিনা বেগম আপনার চার দিক ঘিরে রাখা হয়েছে। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করুন।’ তার এই ঘোষণার পর বাড়ির ভেতর থেকে মহিলা কণ্ঠের আওয়াজ আসে। ভেতর থেকে জবাব দেয়া হয়। বলা হয়- ‘আপনারা শয়তানের পথে আর আমরা হলাম আল্লাহ্র পথে।’ এরপর ওই মহিলার কাছ থেকে আরেক পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে। পুরুষ কণ্ঠ থেকে বলা হয়- ‘দেরি করছো কেন- তাড়াতাড়ি সোয়াট পাঠাও।’ বিকাল ৪ টার দিকে সেখানে আসেন সোয়াটের সদস্যরা। ঢাকা থেকে সড়ক পথেই তারা সিলেটে পৌঁছেন। এরপর তারা প্রথমে পুরো এলাকা রেকি করে অভিযান শুরু করেন। প্রথমে তারা দু’টি ভবনের মধ্যে চারতলা ভবনটি দখলে নেন।
ওই ভবন দখলের সময় তারা তল্লাশিও করেন। কিন্তু কিছু পাননি। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা চারতলা ভবনটি তল্লাশির পর অভিযান বিরতি দেন। পুলিশ কর্মকর্তা জেদান আল মুছা জানান- ‘আমাদের ধারণা- জঙ্গিদের হাতে অস্ত্র ও বিস্ফোরক রয়েছে। যেহেতু ওই ভবনে অনেক লোক আটকা রয়েছেন তাদের কারণে অভিযানে বিলম্ব হচ্ছে।’ এদিকে- রাত ৭ টার দিকে আতিয়ার ভবনে যান সেনাবাহিনীর একটি প্যারা কমান্ডো দল। তারা অভিযানে সহায়তা করতে গেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।