আয়না২৪ প্রতিবেদন
দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র কাঠের তৈরি শিল্পসমৃদ্ধ দৃষ্টিনন্দন মুসলিম স্থাপত্যকলাটির অবস্থান পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায়। বুড়িরচরের আকনবাড়িতে অবস্থিত এই মসজিদের নাম মমিন মসজিদ। সম্পূর্ণ কাঠের নির্মিত কারুকার্য ও ক্যালিগ্রাফি খচিত এ মসজিদটিতে কোনো ধরনের লোহা বা তারকাঁটা ব্যবহার করা হয়নি। এসব কারুকাজে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হয়।
১৯১৩ সালে বুড়িরচর গ্রামের মমিন উদ্দিন আকন নিজ বাড়িতে এ মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ২১ জন কারিগর সাত বছরে ১৬ হাত দৈর্ঘ্য, ১২ হাত প্রস্থ ও ১৫ হাত উচ্চতার এ মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা দিয়ে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়।
২০০৮ সালে মসজিদটির সংস্কার কাজ করা হয়। এ সময় লোহার ব্যবহারসহ মূল ডিজাইনের বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, এ ধরনের কাঠের তৈরি মসজিদ একসময় ভারতের কাশ্মীরেও একটি ছিল। ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পে সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদই এ ধরনের একমাত্র নিদর্শনে পরিণত হয়।
দূরের মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে কষ্ট হয় বলে যুবক মমিন উদ্দিন আকন নিজ বাড়িতে একটি মসজিদ নির্মাণের চিন্তা করলেন। এ উপলক্ষে তিনি বিভিন্ন মসজিদ পরিদর্শনের মাধ্যমে সেগুলোর ডিজাইন ও ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করলেন। বাংলাদেশে বেশিরভাগ মসজিদই তৈরি ইট অথবা পাথরের দ্বারা। এগুলোর বেশিরভাগই মুঘল আমলে তৈরি। এরই ধারাবাহিকতায় মমিন উদ্দিন আকন নিজে ইটভাটায় ইট তৈরি করে মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। কিছুদিন পরে তিনিমসজিদটিকে সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরির পরিকল্পনা নেন। ওই গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িই তখন কাঠের তৈরি। এ ছাড়া গ্রামটি ছিল বিভিন্ন কাঠ ও ফলগাছে পরিপূর্ণ।এ কারণে তিনি মসজিদটি বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতা, ফুল ও আনারসের মতো ফলের ডিজাইনে করার পরিকল্পনা করেন।
দুষ্প্রাপ্য লোহাকাঠ ও বার্মা সেগুনকাঠের ওপর এসব ডিজাইনে ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক রং। যুবক মমিন উদ্দিন আকন তার আরবি ভাষা, ইসলামিক সংস্কৃতি ও ক্যালিগ্রাফির জ্ঞানকে এক্ষেত্রে কাজে লাগান। তিনি নিজে বসবাস করতেন গ্রামের একটি সাধারণ ঘরে এবং সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি তত্কালীন বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি থেকে ২১ জন কারিকর এবং চট্টগ্রাম ও বার্মা থেকে কাঠ সংগ্রহ করেন। মসজিদটির পুরো পকিল্পনা, নকশা ও ক্যালিগ্রাফির কাজ করা হয় মমিন উদ্দিন আকনের তত্ত্বাবধানে। মসজিদের প্রবেশদ্বারে একটি এবং মেহরাবে একটি ক্যালিওগ্রাফির নকশা বসানো হয়।
গত শতকের শেষের দুই দশক ধরে বৃষ্টির পানির কারণে এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মসজিদটির কারুকাজ ও রংয়ের ক্ষতি হতে থাকে। এ সময় মমিন আকনের নাতি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মসজিদটির প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য এবং রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখালেখি করতে থাকেন। এ সময় তিনি ‘মমিন মসজিদ : স্মৃতি বিস্মৃতির খাতা’ নামে একটি বইও রচনা করেন। যার ফলে ২০০৩ সালে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করে।
বর্তমান পিরোজপুর জেলার উদয়তারা বুড়িরচর গ্রামে ১৮৮৩ সালে মমিন উদ্দিন আকনের জন্ম। তার বাবার নাম ইব্রাহিম আকন এবং মা আইশন বিবি। ইব্রাহিম আকন বাংলা এবং ফারসির পাশাপাশি ভালো আরবিও জানতেন। গ্রামে তিনি আকন সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। ১৮৩০ সালে তিনি নিজ পরিবারের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করেন, যেটি আকন বাড়ি নামে পরিচিত। ওই বাড়ির সামনের দিকেই মমিন মসজিদ অবস্থিত।
জানা যায়, মমিন উদ্দিন আকনের পিতামহ ইদ্রিস হাওলাদার ঝালকাঠি থেকে এসে বুড়িরচরে বসতি স্থাপন করেন। বুড়িরচর তখন সুন্দরবনের অংশ ছিল। ইদ্রিস আলী ছিলেন বলকি শাহের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। বলকি শাহ ছিলেন শোষিত কৃষকদের একজন নেতা। ১৭৯২ সালে তিনি ঝালকাঠির সুগন্ধা গ্রামে একটি বিদ্রোহী বাহিনী এবং একটি দুর্গ তৈরি করেন।
কিশোরবেলায় মমিন উদ্দিন আকন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা এক নোয়াখালীর মাওলানার কাছে আরবি ও ফারসি ভাষা শেখেন। মাওলানা সাহেব আকন বাড়িতে মক্তব চালাতেন। তাই ধর্মীয় চেতনাবোধ পূর্বেই তার অন্তঃকরণে উপস্থিত ছিল। ধর্মীয় প্রণোদনা, রুচিবোধ এবং আর্থিক সামর্থ্য ধর্মীয় উপসনালয়টিকে অনেক বেশি সৌকর্যমণ্ডিত করে তোলে। মমিন মসজিদের শৈলী বিচারে তা স্পষ্ট হয়। ২১ জন কাঠ-খোদাই মিস্ত্রি ১৯১৩ সাল থেকে কাজ শুরু করে শাল, সেগুন ও লোহাকাঠ ব্যবহার করে লোহাবিহীন এই অপূর্ব শিল্পকর্মটির কাজ ১৯২০ সালে শেষ করেন। এর চারপাশের বেড়া তিনটি অংশে বিভক্ত। উপরে ও নিচে কাঠের কারুকাজ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দুটি পার্ট দিয়ে ডাবল বেড়া। ভিতরে একরকম ও বাইরে অন্যরকম। ভিতরের কারুকাজ করা বেড়াটি খুলে আলাদা করা যায়। ইট দিয়ে নির্মিত অনুচ্চ নিরেট মঞ্চের ওপর আয়তাকার পরিকল্পনায় কাঠের জোড়াবদ্ধ বেড়া ও খুঁটি সমর্থিত টিনের আটচালা ছাউনি বসিয়ে স্বল্প পরিসরে মমিন মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কাঠের বেড়ার মধ্যে আকর্ষণীয় কারুকাজ বিধৃত হয়েছে। সে কারুকাজের মটিফে ঠাঁই পেয়েছে জ্যামিতিক বিন্যাসে ক্ষুদ্রাকার ফোকর, বরফি, ফুলদানি, স্টাইলিশ কলিসহ বিরুদের ডাঁটা, নাস্তালিক ক্যালিগ্রাফি প্রভৃতি। এর সবকিছুই ধারণ করছে এদেশের লোকজ ঐতিহ্যিক ধারার সর্বশেষ উপাত্ত।
২০০৮ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটির সংস্কার করে। বর্তমানে এটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র কাঠের তৈরি শিল্পসমৃদ্ধ দৃষ্টিনন্দন মুসলিম স্থাপত্যকলা। কাঠের তৈরি মসজিদ একসময় ভারতের কাশ্মীরেও একটি ছিল। ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পে সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে মমিন মসজিদই এ ধরনের একমাত্র নিদর্শনে পরিণত হয়। কাশ্মীরের মসজিদটির কিছু বেড়া অবশ্য এখনও কাশ্মীর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
উল্লেখ্য, সারা বাংলাদেশে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত মসজিদের সংখ্যা শতাধিক। তার মধ্যে যেগুলো বেশি গুরুত্ব বহন করে সেই সব মসজিদের ছবি জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদের কয়েকটি আলোকচিত্রও জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।