আয়না২৪ ডেস্ক
সারাজীবন শুনে এসেছি- ১৪৯২ সালে ইটালিয়ান নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস স্পেনের রানী ইসাবেলার আদেশে সমুদ্র ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এবং তারপর আচমকা আটলান্টিক মহাসাগরে আমেরিকার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সেই ভূখণ্ডটি আবিষ্কার করেন এবং সেখানে প্রথম পা রাখেন। সেই দিনটি নাকি ছিল ১২ই অক্টোবর। পরে শুনলাম যে, কলম্বাস সেখানে পা রাখার আগেও নাকি আদিম কিছু বাসিন্দা সেখানে বসবাস করত। নানা ওয়েস্টার্ন মুভি দেখে বা ওয়েস্টার্ন উপন্যাস পড়ে রেড ইন্ডিয়ান সম্পর্কে ইতিমধ্যে ধারণা পেয়েছিলাম।
সেই রেড ইন্ডিয়ানদের পূর্বপুরুষ, যারা আমেরিকার আদি বাসিন্দা, তারা আসলে কোথা থেকে, কবে আমেরিকায় গিয়েছিল, সে সম্পর্কে অবশ্য অবগত ছিলাম না। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে ও বিভিন্ন ইউটিউব ডকুমেন্টারি দেখে আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাস সম্পর্কে যে ধারণা পেলাম, তাতে রীতিমতো থমকে গেলাম। প্রকৃত বাস্তবতা হল যে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, যিনি কিনা মূলত একজন দাস ব্যবসায়ী ছিলেন, তিনি তার সেদিনকার সমুদ্রযাত্রায় আমেরিকার ভূখণ্ডে পা পর্যন্ত রাখেন নি।
তাহলে কলম্বাস যে সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন, তা কি সম্পূর্ণ নিরর্থক ছিল? কথায় আছে, যতটুকু রটে, কিছু তো বটে! হ্যাঁ, কলম্বাস একটা জায়গায় ঐদিকে পা রেখেছিলেন। জায়গাটা হল- বাহামাস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত একটি দ্বীপ। যেটার নাম তিনি পরে সান সালভাদর রেখেছিলেন। মূল ঘটনাটা ছিল- স্পেনের রানীর অর্থায়নে তিনি বেরিয়েছিলেন ভারতের খুঁজে। তখনকার সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশ, যেমন- ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশগুলো নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর জন্য কলোনির খুঁজে সমুদ্রপথে নানা দেশ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। ভারতের ঐশ্বর্যের কথা ঐ সময় সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্পেনের শাসকেরাও ভারত নামক ভূখণ্ডের কথা শুনেছিলেন, যেখানে প্রচুর সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য সামগ্রী পাওয়া যায়। কলম্বাস তাই ভারত খোঁজার লক্ষ নিয়ে সমুদ্র অভিযানে বেরিয়েছিলেন। তিনি একসময় বাহামাস দ্বীপপুঞ্জের একটিতে পৌঁছেন। সেখানকার লোকবসতি দেখে তিনি ধরে নেন তিনি ভারতে, মানে এশিয়ার একটি দেশে চলে এসেছেন। সে হিসেবে তিনি আদিবাসীদের নাম দেন ইন্ডিয়ান বা ভারতীয়।
যাই হোক, বাহামাস দ্বীপে পৌঁছালে ওখানকার স্থানীয় আদিবাসী তাদের সাদা চামড়া দেখে তাদেরকে দেবতা গোছের কোনো এক জাতি ভেবে খুবই খাতির যত্ন করে। তারা তাদের সাথে সোনাসহ বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী বিনিময় করে। কলম্বাস বুঝতে পারেন, এখানে সবর্ণের খনি রয়েছে, সেই সাথে রয়েছে দাস ব্যবসার সুবর্ণ সুযোগ। কারণ, স্থানীয় বাসিন্দারা খুবই কর্মঠ ও তাদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে। তিনি স্থানীয় কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আর কিছু সামগ্রী নিয়ে স্পেনে ফেরত আসেন। এবং দাবী করেন এশিয়ায় গিয়ে তিনি ভারত আবিষ্কার করেছেন। প্রমাণস্বরূপ তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসা সোনা ও আদিবাসীদেরকে সবার সামনে উপস্থাপন করেন। এরপরে কলম্বাস খুবই ঘৃণ্য কাজ করে বসেন। পরবর্তী সমুদ্র অভিযানগুলোতে তিনি সেই দ্বীপে নিজেদের সৈন্যবাহিনী নিয়ে শুরু করেন দখলদারি। স্থানীয় নিরীহ অধিবাসী দিয়ে সোনা উত্তোলন করিয়ে আবার তাদেরকে বন্দী করে স্পেনে নিয়ে আসেন। সেই সময় সান সালভাদর দ্বীপের হাজার হাজার স্থানীয় অধিবাসী কলম্বাসের বিরোধিতা করতে গিয়ে তার সৈন্যদের হাতে মারা পড়ে।
দাসী হিসেবে বন্দী করে যাদেরকে আনা হয়েছিল স্পেনে, তাদের মধ্যে নয় থেকে দশ বছর বয়সী কিশোরীদের চাহিদা ছিল তখনকার দাস বিক্রির বাজারে খুব বেশী। দাস ব্যবসায়ী কলম্বাস অসংখ্য দাস-দাসী বিক্রি করে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে আরেক ইটালিয়ান নাবিক যিনি ১৫০০ সালের পরে কোনো এক সময় পর্তুগালের হয়ে সমুদ্র অভিযানে বের হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে গিয়ে পৌঁছেন। সেই নাবিকের নাম ছিল আমেরিগো ভেসপুচ্চি। তিনি ব্রাজিলে দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে সেখানে কিছুদিন অবস্থানকালে একসময় হিসেব নিকেশ করে বুঝতে পারেন পৃথিবীর এই অংশটি এশিয়া কিংবা ভারত, জাপান ইত্যাদি দেশের কোনো অংশই নয়। পরে তিনি এই বিষয়টি নিয়ে এবং সেখানকার আদিবাসী ও তাদের সংস্কৃতি নিয়ে একটি পত্র লিখে পাঠান তার এক বন্ধুর কাছে। পরবর্তীতে সবাই যখন জানতে পারে যে কলম্বাস কিংবা আমেরিগো আসলে এশিয়ার কোথাও যাননি, তারা নতুন ভূখন্ডে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন, তখন নাবিক আমেরিগো ভেসপুচ্চির নামানুসারে সেই ভূখণ্ডের নাম রাখা হয় আমেরিকা।
কিন্তু প্রশ্ন হল- আমেরিগো সেখানে যে স্থানীয় আদিবাসীদের দেখেছিলেন, তারাই তো আমেরিকার প্রথম বাসিন্দা। তাহলে এদের পূর্ব পুরুষ কারা ছিল? বিতর্কের কিন্তু অবসান হয়নি এখনও। এদিকে চীন দেশের বণিকের উপস্থিতির চিহ্নও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা আমেরিকায় খুঁজে পেয়েছেন এবং বয়স অনুসারে সেই চিহ্নগুলো বলে যে, কলম্বাসের নূন্যতম সত্তর বছর আগে পর্যন্ত আমেরিকায় চীনা বণিকেরা বাণিজ্যের জন্য যাতায়ত করত।
আরেকটি সূত্রমতে, কলম্বাসের ৫০০ বছর আগে গ্রীনল্যান্ড থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া লিফ এরিকসন নামের এক নাবিক কানাডার উপকূল ঘেঁসে যাবার সময় ঝড়ের পাল্লায় পড়ে কানাডায় পৌঁছে যান। লিফ এরিকসন হচ্ছে স্ক্যানডেনিভিয় অঞ্চলের লোক। নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্ককে একত্রে বলা হয় স্ক্যানডেনিভিয়া অঞ্চল। ৮০০-১০৫০ সালে এই এলাকার বাসিন্দারা ছিল জলদস্যু সম্প্রদায় হিসেবে খ্যাত। লিফ এরিকসনও সম্পদের খোঁজে নতুন নতুন দ্বীপের সন্ধানে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে গ্রীণল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছে। তারপর সেখান থেকে পুনরায় সমুদ্রযাত্রায় বেরোলে ঝড়ের পাল্লায় পড়ে দুর্ঘটনাক্রমে কানাডায় গিয়ে পৌঁছে যায়। কিন্তু সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা এদেরকে তাড়িয়ে দেয়। এখানেও একই সমস্যা- আগে থেকেই অধিবাসী ছিল, হোক সভ্য কিংবা অসভ্য। কারা ছিল এরা? কোথা থেকে এসেছিল এদের পূর্বপুরুষ? যেহেতু মানুষ মানে আজকের হোমো সেপিয়েন্স আফ্রিকাতে বিবর্তিত হয়েছিল হোমো ইরেকটাস নামক প্রজাতি থেকে, সেহেতু সেই হোমো সেপিয়েন্সরই কোনো একটি দল সেখানে কোনো এক সময় পৌঁছেছিল। কারণ আলাদা আলাদা মহাদেশে মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্স আলাদা আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়নি। যদিও হোমো প্রজাতির আরো নানা গোষ্ঠী পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিল, তবে এদের কেউই সেপিয়ন্সে বিবর্তিত হতে পারেনি। আর আদিম আমেরিকানদের যেহেতু নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল, ছিল নিজস্ব সমাজব্যবস্থা, সুতরাং এরা অবশ্যই হোমো সেপিয়েন্সেরই অন্তর্ভূক্ত।
তাহলে কখন সেপিয়েন্সরা ওখানে পৌঁছেছিল? হাজার হাজার বছর আগে, খুব সম্ভব ২০-২৫ হাজার বছর পূর্বে বরফযুগ চলাকালে মঙ্গোলিয়া থেকে রওনা দেয়া কয়েকটি গোষ্ঠী রাশিয়ার সাইবেরিয়া হয়ে স্থলপথে বরফের সংযোগ রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে আলাস্কায় পৌঁছে গিয়েছিল এবং সেখান থেকে কানাডা হয়ে সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে এরা এক-দুই বছরে ওখানে পৌঁছায়নি। হাজার হাজার বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে স্থানান্তরিত হতে হতে প্রায় বারো হাজার বছর আগে এদের উত্তরসূরিরা গিয়ে সেখানে পদার্পন করেছিল। পরবর্তীতে বরফ গলে যাবার পর প্রায় দশ হাজার বছর আগেই এরা পৃথিবীর অন্যান্য মানবগোষ্ঠী থেকে আলাদা হয়ে পড়েছিল।
তবে বর্তমানে আদিম আমেরিকান বা রেড ইন্ডিয়ানদের ডিএনএ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এবং আবিষ্কৃত কিছু পুরাতন ফসিল এর বয়স নির্ণয় করে নৃতত্ত্ববিদেরা বলছেন যে, আদিম আমেরিকানরা শুধু দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা মঙ্গোলিয়ানদের বংশধর নয়, আদিম অস্ট্রেলিয়ান মানব গোষ্ঠীর উপস্থিতির চিহ্নও আছে সেখানে। এখন প্রশ্ন হল- আদিম অস্ট্রেলিয়ানরা কোন পথে, কিভাবে প্রাচীন আমেরিকায় আসতে সক্ষম হবে? এতো অসম্ভব ব্যাপার। সম্ভাব্য উত্তর হল- আজ থেকে প্রায় ষাট হাজার বছর আগে আদিম মানুষদের একটি অংশ অস্ট্রেলিয়ার অভিমুখে যাত্রা করে কোনো এককালে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে গিয়েছিল এবং বাকী গোষ্ঠীরা পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়াতে ছড়াতে কিছু মানুষ তেরো বা সাড়ে তেরো হাজার বছর আগে আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল। এরপর মঙ্গোলিয়ানরা সেখানে বারো হাজার বছর আগে সেখানে পৌঁছে এদের উপর প্রভুত্ব করে এদেরকে বিলুপ্ত করে দেয়। কিন্তু বিলুপ্ত হবার আগে এই আদিম অস্ট্রেলিয়ানদের সাথে মঙ্গোলিয়ানদের মেলামেশার কারণে এদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান রক্তও কিছুটা মিশে যায়, যার নমুনা আজ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন।
সুতরাং বলা যায় যে, ইউরোপিয়ান হিসেবে ৫০০ বছর আগে আমেরিকায় কলম্বাস কিংবা আমেরিগো ভেসপুচ্চি পৌঁছালেও আসলে সেখানে এর অনেক আগে থেকেই মানুষ বসবাস করে আসছিল। কলম্বাসের সময়ের বেশ আগে পৌঁছেছিল চাইনিজরা, তারও অনেক আগে স্ক্যান্ডিভেনিয়ানরা এবং এরও হাজার হাজার বছর আগে মঙ্গোলিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ানদের পূর্বপুরুষেরা সেখানে পা রেখেছিল।