আয়না২৪ ডেস্ক
গণধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ, নির্মম প্রহার, গুমসহ মারাত্মক সব মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। রাখাইন রাজ্য মংডুর উত্তরে এলাকা অবরুদ্ধ করে রোহিঙ্গাদের ওপর এসব নির্যাতন চালিয়েছে তারা। বর্বরোচিত আগ্রাসনে হত্যার শিকার হয়েছে কয়েকশ ব্যক্তি। ৮ মাস বয়সী শিশুও সেনাদের রোষানল থেকে মুক্তি পায়নি। একদিকে ওই শিশুর মাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে, অপরদিকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে শিশুটিকে।
গতকাল প্রকাশিত জাতিসংঘের এক রিপোর্টে এমন বিভীষিকাময় নিপীড়নের বর্ণনা উঠে এসেছে। রাখাইন রাজ্যে গেল বছরের ১০ অক্টোবর শুরু হওয়া সামরিক অভিযানের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, ‘এলাকা নির্মূল অভিযানে কয়েকশ মানুষ নিহত হওয়ার ধারণা করা যায়।’ বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ২০৪ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জাতিসংঘ রিপোর্টটি প্রস্তুত করেছে। এতে আরো বলা হয়, সম্ভাবনা অনেক বেশি যে, মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাহ সংঘটিত হয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগেও জাতিসংঘের একাধিক কর্মকর্তা একই অভিযোগ করেছেন।
ভুক্তভোগীরা বিভীষিকাময় দমন-পীড়নের ঘটনা বর্ননা করেছেন। তাদের অভিযোগ, সেনাবাহিনী ও পুলিশের পাশাপাশি মিয়ানমারের অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক যোদ্ধারা এসব নির্যাতন চালিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃত করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৮ মাস বয়সী এক শিশুকে হত্যার পাশাপশি তার মাকে গণধর্ষণ করে নিরাপত্তা বাহিনীর ৫ সদস্য।
জাতিসংঘ আরো বলেছে, তাদের কাছে ৬ বছরেরও কম বয়সী তিন শিশুকে ছুরি দিয়ে হত্যা করার রিপোর্ট আছে। এর মধ্যে একজনের বয়স ৫। মেয়েটির মা জানান, তার ছোট্ট মেয়েটি তাকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেলে এক ব্যক্তি বড় একটি ছুরি দিয়ে গলা কেটে মেয়েটিকে হত্যা করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ বিন রা’দ জেইদ আল হুসেইন এক বিবৃতিতে প্রশ্ন রাখেন, ‘কোন ধরনের ঘৃণা একজন মানুষকে মায়ের দুধের জন্য কাঁদতে থাকা শিশুকে ছুরিকাঘাত করাতে পারে? আর ওই মাকে নিজ চোখে কোলের শিশুকে হত্যার দৃশ্য দেখতে হচ্ছে, যখন তাকে গণধর্ষণ করছে সেই নিরাপত্তা বাহিনী, যাদের কিনা তাকে সুরক্ষা দেয়ার কথা। এটা কী ধরনের নির্মূল অভিযান? এতে জাতীয় নিরাপত্তার কোন লক্ষ্যমাত্রা উদ্ধার হতে পারে?’ তিনি আরো বলেন, ‘মিয়ানমারের নেতৃত্বকে এমন সামরিক অভিযান বন্ধের আহ্বান জানাতে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাচ্ছি তাদের সর্বশক্তি নিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দিতে। এসব অভিযোগের গভীরতা আর মাত্রা বিশ্ব সম্প্রদায়ের তরফে বলিষ্ঠ প্রতিক্রিয়ার দাবি রাখে।’
জাতিসংঘের সাক্ষাৎকার নেয়া ৪৭ শতাংশ ব্যক্তি বলেছেন, তাদের পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য এ অভিযানে নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের সঙ্গে কথা বলা ২০৪ জনের বেশিরভাগই হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করার কথা জানিয়েছেন। ২০৪ জনের মধ্যে ১০১ জন ছিলেন নারী। এদের অর্ধেকের বেশি ধর্ষণের শিকার বা অন্য ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।
প্রসঙ্গত, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের অনেকে ঘৃণা আর অবজ্ঞার চোখে দেখেন রোহিঙ্গাদের। দেশের জাতিগত সংখ্যালঘু হিসেবে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিতে নারাজ ইয়াঙ্গুন। উল্টো তারা এদের ‘বেঙ্গলি’ বলে আখ্যা দেয়। বেঙ্গলি বলে তারা বোঝায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী। অথচ, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। গত ৯ই অক্টোবর সীমান্ত চৌকিতে হামলায় ৯ পুলিশ নিহত হয়েছিল। এর পরপরই ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের আবাস রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ইয়াঙ্গুন তাদের নিজস্ব তদন্তে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর গণহত্যা চালানোর প্রচারণার কথা অস্বীকার করেছে। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সূ চি নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার বলছে, এসব অভিযোগ বানোয়াট। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক ক্রমবর্ধমান চাপ ঠেকানোর চেষ্টা করেছে সরকার।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা জেইদ এর আগেও পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন ইয়াঙ্গুনকে। গতকাল আরো জোরালো দাবি জানান তিনি। জেইদ বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়নি বারবার এমন অস্বীকৃতি না জানিয়ে মিয়ানমার সরকারকে অবিলম্বে নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে এসব গর্হিত মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে।’