আয়না২৪ ডেস্ক
বড় ধরনের ভূমিকম্প চোখ রাঙাচ্ছে বাংলাদেশকে। ভূগর্ভের যে দু’টি গভীর স্তর বা টেকটোনিক প্লেটের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, সে দু’টি প্লেটের মধ্যে মৃদু সংঘর্ষের ফলে সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরা ও মায়ানামারের মাওলাইকে মাঝারি পাল্লায় ভূমিকম্প হওয়ায় এ শঙ্কা ভর করছে। প্লেট দু’টির সংযোগস্থল বা ফল্ট লাইনে যতো জোরে সংঘর্ষ বাঁধবে ততোই বাড়বে বিপর্যয়ের মাত্রা। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, মৃদু মৃদু সংঘর্ষের পর হঠাৎ বড় সংঘর্ষ হলে ভয়াবহভাবে কেঁপে উঠবে বাংলাদেশ তথা পৃথিবী, সোজা কথায় প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প!
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের গবেষক অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী দিলেন এ কড়া সতর্কতা। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান তিনি।
সাতটি টেকটোনিক প্লেটের ওপর ভাসছে পৃথিবী। পৃথিবীর ভেতরের তাপ আর চাপে গতিশীল এ প্লেটগুলো। ফলে পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই এই প্লেটগুলো একটি অপরটির ভেতরে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছে বা ধাক্কা দিচ্ছে। যে জায়গায় এ সংঘর্ষ হয়, তাকে বলা হয় সাবসনিক জোন। এ রকমই দু’টি টেকটোনিক প্লেটের সাবসনিক জোনে রয়েছে বাংলাদেশ। এর একটি এশিয়ান প্লেট, আরেকটি ভারত এবং ভারত মহাসাগরীয় এলাকা নিয়ে গঠিত প্লেট।
মেহেদি আহমেদ আনসারীর মতে, এ দু’টি প্লেটের ফল্ট লাইন রয়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেটের ডাউকিতে। দু’টি প্লেটের সংঘর্ষের ফলে এই ডাউকি ফল্ট ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ইন্দো-বার্মা ফোল্ড বেল্টে (ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম ফোল্ড বেল্ট) ৫ থেকে ৬ মিটার ভূচ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি অর্জন করেছে ভূগর্ভ স্তর। যেকোনো সময় বড় সংঘর্ষ হলে আঘাত হানতে পারে ভয়াবহ ভূমিকম্প, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা হতে পারে ৭ দশমিক ৫। আর এতো বড় ভূমিকম্প হলে ঘনবসতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজধানী ঢাকা।
মেহেদি কিছু গ্রাফিক চিত্র দেখিয়ে তুলে ধরেন বিপদের শঙ্কার কথা। তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে আসামে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাতে ১ হাজার ৫৪২ জন মারা যান। ওই ভূমিকম্পে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখানো হয়, হিমালয়ান অঞ্চলে (বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান-ভারত-মায়ানমার-তিব্বত-পাকিস্তান) সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিহাসও তারই পক্ষে বলে।গ্রাফউপরের ডান পাশে লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, শিলং থেকে ইন্দো-বার্মা অঞ্চল লাল চিহ্নিত করে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেখানো হয়েছে। আর বাম পাশে লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, সেখানে লাল চিহ্নিত করে শিলং ম্যাসিফ অঞ্চল পরিচিত করানো হয়েছে। এই এলাকাটায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। গবেষণা মতে, ডান দিকের চিত্রে লাল চিহ্নিত (শিলং ম্যাসিফ) অঞ্চল থেকে ডেল্টা অঞ্চল (বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল) হয়ে ইন্দো-বার্মা ফল্ড বেল্টের দিকে ৯০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে ৫ থেকে ৬ মিটার ভূগর্ভ স্তরের চ্যুতি ঘটবে। এতে ঘটবে মারাত্মক ভূমিকম্প। এই অঞ্চলের আওতায় থাকার কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট এবং এর আশপাশের সকল স্থাপনা ধ্বংসের মুখে পড়বে।
বুয়েট ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) এক সমীক্ষা প্রতিবেদন বলা হয়, ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কেবল ঢাকা শহরের ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। এতে দেশের অবস্থা হয়ে উঠতে পারে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের মতো।গ্রাফসাম্প্রতিক ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের আভাস উল্লেখ করে মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ত্রিপুরায় ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের পর মায়ানমারের মাউলাইকে ৫ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এটা বড় ধরনের কাঁপুনির আভাস। আমাদের উচিত ভূমিকম্পের ব্যাপারে সচেতন হওয়া। যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে-কয়ে আসবে না। তাই উচিত হবে, যেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে, তা দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া।
তিনি গার্মেন্টস সেক্টরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে তাদের সমীক্ষার চিত্র তুলে ধরে সবক্ষেত্রে এ সমীক্ষা চালানোরও পরামর্শ দেন। জানান, সমীক্ষার পর ঝুঁকিপূর্ণগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যসব ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে। হয় ভবন মজবুত করতে হবে, নতুবা পরিত্যক্ত বা ভেঙে ফেলতে হবে।
মেহেদি আহমেদ আনসারী জানান, রানা প্লাজা ধসে যাওয়ার পর প্রায় ১০০টি কোম্পানি ট্রেনিং নিয়েছে বিল্ডিং পরীক্ষার ওপরে। সরকারের সহযোগিতা পেলে ১০০ থেকে ট্রেনিং দিয়ে ২০০ টিম করে দুই বছরে সব ভবন পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। সেজন্য সরকারকেই এ পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ গবেষক বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কমিটির মেম্বার হওয়ায় সেক্রেটরিয়েট মিটিংয়ে বিষয়টি উত্থাপন করেছি। বলেছি সব ভবন পরীক্ষা করাতে হবে বলে বিজ্ঞাপন দিতে হবে পত্রিকায়। তখন সাধারণ মানুষ তাদের ভবন পরীক্ষা করিয়ে নেবে।º