আয়না২৪ প্রতিবেদন
সাংসদ লিটন হত্যার রহস্য উদঘাটনে পাঁচ ক্লু সামনে রেখে তদন্তে নেমেছে পুলিশ। মৌলবাদী শক্তির টার্গেট, ব্যক্তিগত শত্রুতা, জেলা পরিষদ নির্বাচন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও জেএমবির কিলিং মিশনকে সামনে রেখে তদন্ত করছে সুন্দরগঞ্জ থানা পুলিশ। তারা বলছেন, যেকোনো সময় হত্যাকারীকে শনাক্ত করে সামনে আনা হবে। হত্যাকারীরা হত্যার আগে দিনভর এলাকায় ঘুরে ঘুরে মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করেছে। এমপি লিটনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার অনিল সাহা বলেন, অপরিচিত দুটি মোটরসাইকেলে ৫ যুবককে একাধিকবার সামনের রাস্তা দিয়ে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। এ ধরনের অনেকেই আসেন এমপির সঙ্গে দেখা করতে। সে কারণে কারো সন্দেহ হয়নি। এসময় এমপি লিটন এলাকার শিশু-কিশোরদের খেলা দেখছিলেন মাঠে বসে। শেষ বিকালে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হিসাব মেলাতে তিনি আসেন নিজ বাড়িতে। জুয়েল, রবিউল আউয়াল, শরিফুল, আলহান, আলামিন, তারাজুল, মোস্তফা, রাকিবসহ অন্তত ১২ কিশোর ক্রিকেট খেলছিল। তাদের কে বাধা মনে করে সন্ত্রাসীরা তাদের খেলা বন্ধ করে দেয়। আর এমপি লিটনকে বলে, ভেতরে চলেন কথা আছে। এই বলে পূর্ব দুয়ারী ঘরে ঢুকতেই জালানা দিয়ে গুলি। এ সময় পাশের রুমে ছিলেন নিহতের বড় ভাই বেদারুল আহসান বেতার ও লিটনের স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি। পরে বুঝতে পারেন ওই অপরিচিত যুবকরাই তাকে গুলি করে পালিয়েছে।
তবে হত্যা মিশনে ঠিক কতজন সন্ত্রাসী অংশ নিয়েছে তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ বলেন ৫ জন, কেউ বলেন তার চেয়েও বেশি। তিনজনের পরনে জিন্সের প্যান্ট আর দুটি মোটরসাইকেল। একটি মোটরসাইকেলে তিনজন ও আরেকটিতে দুজন। দুজনের মটরসাইকেলটি অনবরত এদিক সেদিক চলাচল করেছে। আর তিনজনের মোটরসাইকেলের সবাই ছিল যুবক। তাদের পকেটে ছিল কি যেন। ওরা এসে আমাদের খেলা বন্ধ করে বাড়ি যেতে বললে আমরা মাঠ ছেড়ে রেললাইনের দিকে চলে যাই। তারপর গুলির শব্দ। পাশ দিয়ে ওই মটরসাইকেলে করে পিস্তল বের করে দ্রুত চলে যায়। দৌড়ে এসে দেখি চিৎকার, কান্নাকাটি, রক্ত আর এমপি ভাই মাটিতে পড়ে আছে। এ কথাগুলো অকপটে জানায় কিশোর জুয়েল। সে আরো জানায়, তাদের দেখলে চিনতে পারবে। এমপির বড় বোন আফরোজা বারী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা শুধু জামায়াত-শিবির হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে নিশ্চিত না। আত্মীয়, রাজনৈতিক বন্ধুসহ নানা কারণে খুন হতে পারে। তাদের বাদ দিয়ে মামলা করা হয়নি। মামলায় কারো নাম দেয়া হয়নি কারণ পুলিশ খুঁজে বের করবে কারা লিটনের খুনি। সন্দেহের বাইরে কেউ নয়। কারণ, ঘটনার আগে বাড়িতে এতো লোকজন থাকলেও হত্যাকাণ্ডের সময় তারা কোথায় ছিল? কী কারণ থাকতে পারে তাদের অনুপস্থিতির। তাছাড়া হত্যাকাণ্ডের পরপরই রংপুরে মামলার জন্য কাগজ খসড়া করা হয়। তাতে শুধু জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে দায়ী করা হয়। আইনজীবীদের পক্ষ থেকে আমাদেরকে বলা হয়, আপনারা শুধু কাগজে স্বাক্ষর করে সুন্দরগঞ্জ থানায় জমা দিবেন কিন্তু আমরা তা করিনি । আমরা মনে করেছি শুধু জামায়াত কেন হত্যার সঙ্গে অন্য কারণও থাকতে পারে। কাজেই এক পেশে মামলা করা যাবে না। তাহলে প্রকৃত খুনিরা পার পেয়ে যাবে।
এই বয়সে আমাকে বিধবা হতে হবে তা ভাবতেও পারিনি। বিয়ের পর থেকে মানুষের সেবা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে স্বামী লিটনের পাশে থেকেছি। অনেক ত্যাগ, মামলা মোকদ্দমা দুঃখ-কষ্টের পর এমপি হয়েছিলেন লিটন। নির্বাচনের পর থেকেই আমরা ছিলাম হুমকির মুখে। জামায়াত-শিবিরের মূল টার্গেটের মধ্যে ছিলাম। কোথাও গেলে গানম্যান ও আমি সঙ্গে থাকতাম। কী একটা ঘটনায় তার কাছে থেকে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র জমা দিতে হলো। তারপর থেকে জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে কাজ করছি। স্বামীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দুই চোখে পানি ধরে রাখতে পারলেন না লিটনের স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি। একটু আড়াল হতেই শত্রুরা ওকে গুলি করে পাখির মতো হত্যা করলো। অপরদিকে আন্দোলনে সুন্দরগঞ্জ উত্তাল হলেও অনেক দলীয় নেতাকর্মীদের অনুপস্তিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। আওয়ামী লীগ নেতা সমেশ উদ্দিন বাবু বলেন, আমরা শুধু আন্দোলন করে গেলাম। এমপির নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন করেছি কিন্তু প্রকল্পের চাল ও গমের হিসাব করেন অন্য নেতা। তাদের আজ আর দেখা যায়নি ।
লিটন হত্যা মামলার বাদী তার ছোট বোন তাহমিদা বুলবুল কাকলী সাংবাদিকদের জানান, তার ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হলো আর তিনি বসে থাকবেন। এজন্য তিনি মামলা করেছেন সুন্দরগঞ্জ থানায় ৫ জনের বিরুদ্ধে। আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি। এমপি লিটনের স্বজনরা জানিয়েছেন, অনেক আগে থেকেই এমপিকে হুমকি দেয়া হচ্ছিল। কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। তার বাড়িতে নিরাপত্তা দেয়া হয়নি।
তবে নিহত সাংসদের স্ত্রী সৈয়দ খুরশিদ জাহান স্মৃতি তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তার স্বামীর হত্যার পেছনে দলীয় কোন্দল কাজ করতে পারে। কারণ এর আগে তাকে হত্যার জন্য ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। তাছাড়া মীরগঞ্জের শিশু শুভ হত্যার ঘটনায় এমপি কে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। তবে তিনি সাংবাদিকদের কাছে বলেন, তার স্বামী জামায়াত-শিবিরের টার্গেট কিলিংয়ের শিকার।
সুন্দরগঞ্জে তদন্তকারী দারোগা বলেন, আমরা পাঁচটি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্তে নেমেছি। এদিকে আজ এমপি লিটনের কুলখানি। সকাল থেকে কোরআনখানিসহ নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কুলখানির প্রস্তুতি।