মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘বহুবিধ সূচক গুচ্ছ জরিপ’ (MICS) ২০১২-১৩-এর তথ্য অনুযায়ী গ্রামের ৯৮ শতাংশ মানুষ পানি সুবিধার আওতায় রয়েছে, যদিও দেশের প্রায় ১২.৪ শতাংশ মানুষ এখনো আর্সেনিকযুক্ত টিউবওয়েলের পানি পান করছে। অর্থাত্ পরিসংখ্যান হিসেবে এখনো ২ কোটি ৪ লাখ মানুষ নিরাপদ ও সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে যৌথ পরিবীক্ষণ কর্মসূচি বা JMP ২০১৫ তথ্য অনুযায়ী ৮৭ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধার আওতায় রয়েছে।
বিশ্বের ৩০ ভাগ স্থল এলাকা ও ৭০ ভাগ পানি। এর মাত্র ৩ শতাংশ মিষ্টি পানি (খাবার, পারিবারিক বিভিন্ন কাজ, কৃষি কাজ ও শিল্পখাতে উপযোগী) এবং বাকি ৯৭ শতাংশ লোনা পানি। সুপেয় এবং নিরাপদ পানির জন্য সারাবিশ্বেই হাহাকার এবং সম্ভবত সে কারণেই বলা হয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পানির কারণেই হবে। এরকম পরিস্থিতিতে পানির অধিকার সংরক্ষণে আজ বিশ্বব্যাপী সকলেই সোচ্চার। এই নদীমাতৃক দেশে আমরা সত্তর দশক থেকেই ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। টিউবওয়েল হচ্ছে আমাদের একমাত্র উত্স। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে এবং পানি সংকটাপন্ন এলাকায় পানির প্রাপ্যতা সাপেক্ষে পানি আইন ২০১৩ এ সুপেয় পানির উত্স হিসেবে দীঘি, পুকুর বা অনুরূপ জলাধার সংরক্ষণে বিশেষ জোর দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ এর অধীনে প্রণীত হয় খসড়া বাংলাদেশ পানি বিধিমালা ২০১৭। চতুর্দশ (১৪) অধ্যায় সংবলিত এই খসড়া বিধিমালাটি শীঘ্রই চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে আছে।
এই আইন ও বিধিমালার মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলেও ভূ-উপরস্থ পানি বিশেষ করে পুকুর, জলাশয় ও নদী বা খালের পানিকে খাবারের পানি হিসেবে ব্যবহারের বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়নি। গভীর নলকূপ, সাবমারসিবল পাম্প ব্যবহারের মাধ্যমে অগভীর নলকূপের লাইসেন্স অথবা ছাড়পত্রের বিষয়ে নানা উদ্যোগ ও নিয়মের কথা বলা হয়েছে। যদিও পান করা বা গৃহস্থলী কাজের জন্য হস্তচালিত পাম্প অথবা হস্তচালিত গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের ক্ষেত্রে; লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই পানি আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য খসড়া বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়, যা জনগণের দলিল। এখন প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মাধ্যমে যথাযথ বাস্তবায়ন ও তার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটারএইড-এর গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন খাতে মোট উন্নয়ন বাজেট ৪৮৪৮ কোটি টাকা যা জাতীয় উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৪.৩১% এবং এই বরাদ্দের ৮৬% বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে শহরের জন্য এবং অন্যান্য এলাকায় বিশেষ করে গ্রামে মাত্র ১৪% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
উন্নয়নে মানুষ কেন্দ্রিক বা জনপ্রতি বরাদ্দ রাখার দাবি অনেক দিনের। এই বিবেচনায় বরাদ্দের পরিমাণ গ্রামেই বেশি হওয়া উচিত যেহেতু জনসংখ্যার সিংহভাগ (৬৪.৪ শতাংশ) মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে। আসলে জনপ্রতি বরাদ্দ বিবেচনায় বাজেট প্রণয়ন না হলে কার জন্য বরাদ্দ, কোথায় বরাদ্দ, কী উদ্দেশে বরাদ্দ এবং জনগণ কিভাবে এ থেকে সুবিধা পাবে তা নির্ধারণ করে সঠিক ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন কষ্টসাধ্য বা টেকসই নাও হতে পারে।
এছাড়া এবারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (২০১৫-২০৩০) ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যের প্রায় সব কটিতেই ‘END’ এবং ‘Ensure’ এর কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হয়েছে। অর্থাত্ আগামী ১৫ বছরের মধ্যে অনেক বিষয়ের অর্জন নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি লক্ষ্য (লক্ষ্য-৬) নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সকলের জন্য পানি ও স্যানিটেশনের প্রাপ্যতা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা’। আশা করি এরকম অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর এবং পানি সংক্রান্ত জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের প্যানেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দশ রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে একজন অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হওয়াটা তারই অনন্য একটি উদাহরণ। সুতরাং জাতীয় পর্যায়ে এবং বিশ্ব দরবারে আমাদের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করছে এবং সেই দায়িত্ব ও ইচ্ছা থেকেই অতিসত্বর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। ব্যয় নির্ধারিত হলে আয় নির্ধারণ করা যাবে এবং সামগ্রিকভাবে বাজেট প্রণয়ন সম্ভব হবে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের এক বছর (২০১৬) পেরিয়ে আমরা এখন দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করেছি এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে আগামী অর্থবছরের ২০১৭-১৮ বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে কিছু পদক্ষেপ আশু প্রয়োজনীয়। উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে নদী ভাঙন এলাকা, লবণাক্ত প্রবণ এবং ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকাসহ হাওর ও বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য পানি ও সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় ন্যায্যতাভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। উন্নয়ন বাজেটে গ্রামের জন্য উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সুপেয় পানি ও এর ব্যবস্থাপনা বরাদ্দ এখন সময়ের দাবি। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, প্রবেশগম্যতা ও গুণাগুণ যেমন বাড়ানো প্রয়োজন, তেমনি সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে ফলপ্রসূ করতে টেকসই বিনিয়োগও দরকার।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৬-এ বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে নিম্ন দরিদ্রের হার ১২.৮৯ শতাংশ এবং সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০২০) ২০২০ সালের মধ্যে নিম্ন দরিদ্রের হার ৮.৯ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পানি ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব না দিয়ে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। সুতরাং টেকসই লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রকল্প যেমন সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যে ও পরিচর্যা বৃদ্ধি, সুপেয় পানি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: গবেষণা ও পরিকল্পনা পরিচালক, ডর্প