ফোবিয়াগুলো যখন গ্রাস করে ফেলে ব্যক্তিকে!

Spread the love

ক্লস্ট্রোফোবিয়াঃ বদ্ধ বা ছোট জায়গা নিয়ে আতঙ্ক

সীমাবদ্ধতা বা দমবন্ধ হওয়ার ভয় থেকে এই ফোবিয়ার সূত্রপাত ঘটে। এই ফোবিয়াটি নিয়ে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞগণ বহু গবেষণা করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, শতকরা মাত্র ২ ভাগ ভুক্তভোগীই এর চিকিৎসার শরণাপন্ন হন। ক্লস্ট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি লিফটে চড়তে ভয় পান, গাড়ির জানালা বন্ধ করতে চান না, সুড়ঙ্গ বা গুহার সম্পর্কে তার মধ্যে চূড়ান্ত ভীতি কাজ করে। এজন্য মাঝে মাঝে সহজ রাস্তা বাদ দিয়ে সময়বহুল পথও বেছে নেন এই ক্লস্ট্রোফোবিকেরা।

 

সীমাবদ্ধ বা ছোট জায়গায় আতঙ্ক, ক্লস্ট্রোফোবিয়া, es.pinterest.com

সীমাবদ্ধ বা ছোট জায়গায় আতঙ্ক, ক্লস্ট্রোফোবিয়া; es.pinterest.com

পৃথিবীর জনসংখ্যার শতকরা ৪ ভাগ মানুষই এই ফোবিয়াতে আক্রান্ত। একজন ক্লস্ট্রোফোবিক যদি কোনো বদ্ধ জায়গায় আটকা পড়েন, তবে তার শ্বাসকষ্ট হতে পারে, তিনি অনেক ঘামতে থাকবেন এবং বেশি সময় এ অবস্থায় থাকলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনাও আছে। এ ধরনের ব্যক্তির কবরে আটকা পড়ে মারা যাওয়ার ভয় খুব বেশি কাজ করে। কোনো একদিন তাকে জ্যান্ত কবরে পুঁতে ফেলা হবে এমনটি ভাবতে থাকেন তিনি।

অন্যরা কীভাবে বদ্ধ জায়গায় শান্ত থাকতে পারে, ক্লস্ট্রোফোবিকরা এ থেকেও সাহস সঞ্চয় করতে পারে। এক্ষেত্রে একটু একটু করে দুই-এক তলা করে লিফটে চড়ার অভ্যেস করা, তখন সাথে বিশ্বস্ত কাউকে রাখা কাজে লাগতে পারে। কারণ দিন শেষে আতঙ্কের মুখোমুখি হওয়াটাই আতঙ্ক থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।

এস্ট্রাফোবিয়াঃ বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকানো নিয়ে আতঙ্ক

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ঝড়-তুফান, বজ্রপাত, বিদ্যুৎ চমকানো খুব সাধারণ ঘটনা হিসেবে নেয়া হয়। কিন্তু একজন এস্ট্রাফোবিক, তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, তার কাছে এগুলো অনেক বেশি ভীতিকর এবং এ থেকে তার উভয় প্রকার শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা হতে পারে।

বাচ্চাদের মধ্যে এ আতঙ্কটি বেশি দেখা যায়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক স্তরেও এ আতঙ্ক সমান প্রভাব বিস্তার করে। ভুক্তভোগীরা বজ্রপাত বা বিদ্যুৎ চমকানো দেখলে লুকিয়ে পড়তে পারেন। কাঁপাকাঁপি, এক জায়গা থেকে সরতে না চাওয়া, দরজা-জানালা থেকে দূরে অবস্থান করা, বারবার আবহাওয়া সংবাদ দেখা- এ সবকিছুই এই ফোবিয়ার সাধারণ লক্ষণ।

এ ধরনের অবস্থায় কোনো পোষা প্রাণী বা প্রিয় বন্ধুর সাথে থাকলে এবং মেজাজ ফুরফুরে রাখার চেষ্টা করলে ভীতি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়। বই পড়া, সিনেমা দেখা, গান শোনা- এককথায় আতঙ্কটি থেকে মনকে বিরত রাখা আতঙ্ক কাটানোর ভালো উপায়।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বাবা-মাকে তাদের ভয় কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে, আতঙ্ক বেশি বেড়ে গেলে সাইকোথেরাপি নেয়া যায় যেতে পারে।

সাইনোফোবিয়াঃ কুকুর নিয়ে আতঙ্ক

অনেকেই আদর করে কুকুর পোষেন। কুকুর দেখলে মনে মায়া কাজ করে এমন মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আরেক দলও আছেন, কুকুর দেখলেই আতঙ্কে যাদের গায়ের লোম প্রায় খাড়া হয়ে যায়! এই আতঙ্কটিই ‘সাইনোফোবিয়া’। কুকুরপ্রেমীরা প্রায় সময়ই এই সাইনোফোবিকদের নিয়ে হাসাহাসি করেন এবং কখনো কখনো রেগেও যান তাদের আদরের প্রাণীর প্রতি এ অবিচার দেখে! তাই কুকুরের প্রতি আচরণের এই বৈপরীত্য থেকে প্রায়ই হয়ে যায় দ্বন্দ্ব!

দেখা গেছে, যারা কুকুর খুব ভয় পান, তাদের অধিকাংশই বেড়ালেও ভয় পান এবং শতকরা ৭৫ ভাগ সাইনোফোবিকই হচ্ছেন নারী। জুফোবিয়ার (পশুপাখি নিয়ে আতঙ্ক) মধ্যে অন্যতম হলো এই সাইনোফোবিয়া। সাইনোফোবিকরা কুকুর পোষেন এমন ব্যক্তি থেকেও দূরে থাকতে চান।

ছোট কুকুরছানাও এদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়!, anxietydisordertest.net

ছোট কুকুরছানাও এদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়!; anxietydisordertest.net

সাধারণত আকারে বড় কুকুরকেই ভয় পান তারা। কিন্তু ফোবিয়াটি যখন চরমে থাকে, তখন আকার-বর্ণ নির্বিশেষে ছোট আদুরে কুকুরছানাকে দেখেও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন সাইনোফোবিকরা! কুকুরকে বলা হয় বিশ্বস্ত প্রাণী এবং আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত কুকুরের সাথে মানুষের বন্ধুত্ব বিশেষ একটি স্থান নিয়ে আছে মানবজীবনে। কিন্তু সাইনোফোবিকদের কাছে কুকুর মানেই শত্রু, ক্ষতিকর।

কুকুর সামনে আসলেই কামড়ে দিবে, এমন একটি ধারণা সাইনোফোবিকরা পোষণ করেন। এ আতঙ্ক থেকে কেউ কেউ কুকুর দেখলে অকারণে আঘাতও করে বসে! কুকুর দেখলে দৌড়ে পালানো একটি সাধারণ লক্ষণ।

এক্ষেত্রে সাইনোফোবিকদের কুকুরের সাহচর্যের ব্যাপারটি বোঝাতে হবে এবং সম্ভব হলে একটি কুকুরছানা পুষতে দেয়া যায়। তাকে লালন-পালন করতে গেলে কুকুরের প্রতি ভীতি নিজে থেকেই চলে যাবে।

এগোরাফোবিয়াঃ খোলামেলা স্থান, মানুষ আর ভীড়ে যে আতঙ্ক

সামাজিক পরিবেশে বা ভিড়বাট্টা আছে এমন স্থানে যেতে অস্বস্তি বোধ করেন এগোরাফোবিকরা। মানুষজন বেশি আছে এমন পরিবেশ থেকে দ্রুত পালাতে চান তারা। এগোরাফোবিকরা নতুন সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, মানুষজনের সাথে প্রসারিত অর্থে মেলামেশা করাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেন। এরা ভদ্রতার লেহাজ ততক্ষণ পর্যন্তই রক্ষা করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এই ফোবিয়াটি সহনীয় স্তরে থাকে।

মানুষজনকে রীতিমতো ভয় পান এরা, www.imagekind.com

মানুষজনকে রীতিমতো ভয় পান তারা; www.imagekind.com

ফোবিয়াটি ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং একসময় ভদ্রতা বা সামাজিক সৌজন্যের সীমানাটুকুও মেনে চলা কঠিন হয়ে যায়। এতে করে তারা দিনে দিনে একঘরে ও হতাশ হয়ে পড়েন, আশেপাশের ঘটনা সম্পর্কে কৌতূহল ও সচেতনতা উভয়েই কমতে থাকে। নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রাখতে স্বস্তি বোধ করেন এগোরাফোবিকরা। এই আচরণের পক্ষে নিজস্ব কিছু যুক্তিও দাঁড় করিয়ে ফেলেন তারা!

মানুষ আসলে আজকাল এত বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে যে এগোরাফোবিকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতি ১০০ জন আমেরিকানের মধ্যে ২ জন এই ফোবিয়ার শিকার। এগোরাফোবিকদের মেলামেশা ও পরিচিতির সীমানা ক্রমশ সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হতে থাকে।

ভীড় মানেই আতঙ্ক, www.clarin.com

ভীড় মানেই আতঙ্ক, www.clarin.com

মদ্যপান, নেশাদ্রব্য গ্রহণ, নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা, নার্সিসিজম, সুপিরিয়র ও ইনফিরিয়র কমপ্লেক্স এগোরাফোবিয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত। মানুষ যখন অন্যের কাছে আশানুরূপ আচরণ পায় না অথবা মানুশ যখন নিজেকে নিয়ে অতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখনই এগোরাফোবিয়া প্রভাব বিস্তার করে। এগোরাফোবিকদের আরেকটি মজার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এরা আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগে অপেক্ষাকৃত বেশি পারদর্শী এবং একসময়ে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিই এদের কাম্য।

প্রিয়জনকে নিয়ে অতিরিক্ত ঈর্ষাও এর একটি লক্ষণ। এরা সামাজিক আবহাওয়ার চাইতে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক এলাকাই বেশি বেছে নেয়। এই ফোবিয়া থেকে বের হয়ে আসার উপায় হতে পারে ছোট ছোট দলে নিজের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে আলোচনা করা, দলীয় মতবিনিময় চর্চা এবং ধীরে ধীরে দলটি বড় করা।

এক্রোফোবিয়াঃ উচ্চতাভীতি

অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যেই এই ফোবিয়াটি দেখা যায়। এরোফোবিয়ার সাথেও এর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। উঁচু স্থানে উঠলে, দাঁড়িয়ে থাকলে, এমনকি উঁচু স্থানে অবস্থান না করলেও উঁচু থেকে পরে যাবার যে ভয়, তাকেই বিজ্ঞান বলে ‘এক্রোফোবিয়া’। এক্রোফোবিয়া শব্দটি এসেছে গ্রীক ভাষা থেকে। গ্রীক শব্দ ‘acros’ অর্থ উচ্চতা ও ‘phobos’ অর্থ ভীতি।

শুধুমাত্র এই আতঙ্কের কারণেই অনেকে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় পড়ে যান। প্রতি ২০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ১ জন এই ফোবিয়ার শিকার। এক্রোফোবিকরা উঁচু বিল্ডিং এর ছাদ, উঁচু বারান্দা এড়িয়ে যান। এদের মতে উঁচু স্থান থেকে নিচে তাকালে মাথা ঘোরে এবং তারা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এই ফোবিয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বেশ গভীর প্রভাব ফেলে। বিনোদনের অনেক বিষয়েই বাধা হয়ে দাঁড়ায় এক্রোফোবিয়া। রোলার কোস্টার, নাগরদোলা, দোলনা কিছুই উপভোগ করতে পারেন না এক্রোফোবিকরা। অনেক বড় বড় দুর্ঘটনারও কারণ হতে পারে এক্রোফোবিয়া। যেমন ব্রীজের ওপর দিয়ে গাড়ি চালানোর সময় যদি ফোবিয়া জেঁকে বসে, তখন চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বড়সড় দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন।

উঁচু থেকে পড়ে যাবার ভয়, www.modasta.com

উঁচু থেকে পড়ে যাবার ভয়, www.modasta.com

মনোবিজ্ঞানীরা এ ফোবিয়াকে মূলত নেতিবাচক মনমানসিকতার ফল বলে মনে করেন। এর চিকিৎসা হিসেবে Hypnosis ভালো একটি উপায়। এছাড়া এর জন্য চিকিৎসকরা ওষুধও দিয়ে থাকেন।

ফোবিয়া বা আতঙ্ক ক্রমেই গ্রাস করে ফেলে ব্যক্তিজীবন, এ আগ্রাসন এর কারণ খুঁজতে গেলে নিজের মধ্যে, আশেপাশের পরিবেশের মধ্যেই তার উত্তর মিলবে; এবং তারপর মিলবে সমাধান। সকল ফোবিয়ার আগ্রাসন থেকে মুক্ত হোক মানবমন