আয়না ২৪ প্রতিবেদন
সারা দেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, নওগাঁ, নাটোরসহ কয়েকটি জেলার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তবে দিনাজপুর, লালমনিরহাট জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে জামালপুরে সাতজন ও গাইবান্ধায় দু’জন মারা গেছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
এদিকে বন্যায় গতকাল বুধবার পর্যন্ত সারা দেশে ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৯২ জন মারা গেছে পানিতে ডুবে। গত ৪৮ ঘণ্টায় মারা গেছে ২৪ জন। দিনাজপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি ২৩ জন মারা গেছেন। বন্যায় এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৩৩ লাখ মানুষ।
জামালপুরে গতকাল বুধবার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। জেলা সদরসহ সাতটি উপজেলায় প্রায় ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। ৮৭৩ শিাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে শিাকার্যক্রম। এ ছাড়া বন্যায় তলিয়ে গেছে প্রায় ৩৩ হাজার হেক্টর ফসলি জমি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, জেলার মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের আটাবাড়ি গ্রামের কৃষক আজিবর মোল্লা নিজ বাড়ির পাশে ভেলায় চড়ে রাস্তায় উঠতে গিয়ে বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে গুরুতর আহত হয়ে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যান। এ ছাড়া মেলান্দহ পৌরসভায় নলবাড়িয়া গ্রামের ময়না মিয়ার ছেলে সজীব মিয়া ও নাগেরপাড়া গ্রামের জিল্লুর রহমান নামে দুই বন্ধু বুধবার সকালে বন্যার পানি দেখতে গিয়ে প্রবল স্রোতে ভেসে নিখোঁজ হয়। এ সময় তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে লাল মিয়া নামে এক ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যান। পরে সজীব মিয়া ও জিল্লুর রহমানের লাশ পাওয়া যায়। মৃত সজীব মিয়া ও জিল্লুর রহমান মেলান্দহ উমির উদ্দিন পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিার্থী।
একই উপজেলার আলেয়া আজম কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিার্থী কমল শেখ বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। সে জেলার মেলান্দহ উপজেলার কুলিয়া গ্রামের পাগু শেখের ছেলে। কমল শেখ কয়েকজন বন্ধুর সাথে মঙ্গলবার দুপুরে কুলিয়া ঈদগাহ মাঠের পাশে বন্যার পানিতে গোসল করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। মঙ্গলবার রাতে তার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
অন্যদিকে ভোর রাতে গোপালপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার ভেঙে যমুনার পানির প্রবল স্রোত হুরাসাগরে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী, জালালপুর, বেলতৈল ইউনিয়নের হাজারো একর আমন ধান, ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। এ দিকে বাঁধটি শাহজাদপুর উপজেলা সদরের সাথে এনায়েতপুরের দু’টি ইউনিয়নের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা হওয়ায় যাত্রাপথে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার কাজিপুর, সদর, শাহজাদপুর, বেলকুচি, চৌহালী উপজেলার চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে বন্যাকবলিত এলাকায় তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ, ৩৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ, আট হাজার ২৩৪টি ঘরবাড়ি অংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া দুই হাজার ৪৯৪ হেক্টর ফসল ও ৩০ কিলোমিটার রাস্তা-বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গতকাল গোয়ালন্দ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, পানি বৃদ্ধির কারণে উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ৬০টি, উজানচর ইউনিয়নের ১৫টি, দেবগ্রামের ৮টি ও ছোট ভাকলা ইউনিয়নের ৫টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের প্রায় ১৬ হাজার ৯০০ পরিবারের ৫০ হাজার ৬০০ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিন পার করছে। ৭টি শিাপ্রতিষ্ঠান বন্যাকবলিত হয়ে পড়ায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপজেলার প্রায় ৬৫ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এসব ইউনিয়নের বন্যাকবলিতদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৫৮.৮ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
নোয়াখালী সংবাদদাতা জানান, ভারী বর্ষণে নোয়াখালীর ছয়টি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এতে জেলা সদর, বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী হাতিয়া ও চাটখিল উপজেলার গ্রামের প্রায় শত ভাগ রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে এবং ৯০ ভাগ বাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। জেলার প্রধান বাণিজ্য শহর চৌমুহনী পৌরসভার করিমপুর, হাজীপুর, গনিপুর কিসমত করিমপুর গ্রামের বেশির ভাগ রাস্তা ও বাসাবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত হয়।
ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) সংবাদদাতা জানান, যমুনায় পানি বৃদ্ধির ফলে ভূঞাপুরের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সেতু-ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। গত কয়েক দিনের অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধিতে বঙ্গবন্ধু সেতু-ভূঞাপুর-তারাকান্দি বাঁধে কুঠিবয়ড়া বাজার, গোলপেচা ও সোনামুই এলাকায় ফাটল দেখা দিয়েছে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। কিন্তু এতেও আশঙ্কা মুক্ত না হওয়ায় এ সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তারাকান্দি থেকে উত্তরবঙ্গ ও দণিাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা। কোথাও কোথাও বাঁধের ওপর দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। যেকোনো সময় বাঁধটি ভেঙে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। এতে জেলার আরো তিনটি উপজেলা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত যমুনার ভূঞাপুর অংশে বিপদসীমার ১৩৫ সেমি ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
চরভদ্রাসন (ফরিদপুর) সংবাদদাতা জানান, চরভদ্রাসন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। বুধবার দুপুর ১২টায় উপজেলা পদ্মা নদীতে বন্যার পানি বিপদসীমার প্রায় ৭৯ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার পরিবারের বসতঘর পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে এবং পদ্মা নদীর আশপাশ এলাকার শত শত একর আমনক্ষেত তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া রাস্তাঘাট ও কালভার্টের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছেন।
মোহনগঞ্জ (নেত্রকোনা) সংবাদদাতা জানান, গত কয়েক দিনের বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ধান সমৃদ্ধ অঞ্চল মোহনগঞ্জের অধিকাংশ রোপা আমন বীজতলাসহ ডুবে গেছে কয়েক শ’ একর রোপণকৃত জমি। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় উঁচু জমির বীজতলাও পানি উঠে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বুধবার সকালে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সুয়াইর ইউনিয়নের সেখুপুর, পালগাঁও, ভরাম, নলজুরী, পাবই, সুয়াইর, হাটনাইয়া, মাঘান সিয়াধারের মানশ্রী, কুড়েরপাড়, বড়তলী বানিয়াহারীর বড়তলী এলাকাগুলোয় বেশি ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় উপজেলার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডুবে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো সাময়িক বন্ধ রয়েছে।