
আয়না২৪ প্রতিবেদন
তিনি ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। ফেনী জেলায় তার কথাই ছিল আইন। তার অঙ্গুলি হেলনে চলত ফেনীর রাজনীতি, জীবনযাত্রা। জাতীয় গণমাধ্যমে তাই তিনি সংবাদ শিরোনাম হতেন প্রায়ই, যার বেশির ভাগ ছিল নেতিবাচক সংবাদ। ফলে সারা দেশে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘ফেনীর গডফাদার’ নামে। তিনি জয়নাল আবদীন হাজারী। জয়নাল হাজারী নামে যাকে চেনে সবাই।
ফেনীতে তার ‘স্ট্যান্ডিং কমিটি’ নামের এক ‘সরকার ছিল সেখানকার বিভীষিকার নাম। এই কমিটির মাধ্যমে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো ফেনী শহর।
নেতাকর্মী-ক্যাডার পরিবেশিষ্ট হয়ে চলা একসময়ের প্রভাবশালী এই মানুষটি এখন আনসার পাহারায় বাস করছেন বিরলে-নিভৃতে। সঙ্গী নিজের সম্পাদিত দৈনিক পত্রিকা ‘হাজারিকা প্রতিদিন’। আর চার-পাঁচজন সহকারী। থাকেন রাজধানীর ধানমন্ডির এক ফ্ল্যাটে।
ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল হাজারী ফেনী-২ (সদর) আসন থেকে ১৯৮৬ সালের তৃতীয়, ১৯৯১ সালের পঞ্চম এবং ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে যে কয়জন সংসদ সদস্য নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচিত ছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন জয়নাল হাজারী। এর জবাবে তিনি বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, বিএনপি প্রভাবিত ফেনী জেলায় আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখার জন্যই লড়াই করতে হয়েছে তাকে।
কিন্তু তার এই ‘লড়াই’ এরপর আর বেশি দিন টেকেনি। ২০০১ সালের ১৭ আগস্ট তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশ ছেড়ে পালান জয়নাল হাজারী। ওই দিন গভীর রাতে কার্ফু জারি করে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে তল্লাশি চালানো হয় তার বাড়িতে। কিন্তু তার আগে পালান জয়নাল হাজারী।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফিরে আসেন তিনি। এরই মধ্যে পাঁচটি মামলায় ৬০ বছরের সাজা হয় তার। এরপর ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করলে হাজারী আট সপ্তাহের জামিন পান। পরে ১৫ এপ্রিল নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে পাঠানো হয় কারাগারে। প্রায় চার মাস কারাভোগের পরে ২০০৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর মুক্ত হন তিনি।
কিন্তু তত দিনে ফেনীর সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যায় জয়নাল হাজারীর। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দীর্ঘদিন বিদেশে পালিয়ে থাকার সময় ফেনীর রাজনীতিতে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি কমে যায় অনেকটা। দীর্ঘদিন পরে দেশে এলেও তা আর পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। রাজনীতিতেও তেমন সক্রিয় দেখা যায়নি তাকে। বেশির ভাগ সময় অবস্থান করেন ঢাকায়। এরপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফেনী-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তারই একসময়ের অনুসারী নিজাম উদ্দিন হাজারী।
রাজনীতির মাঠে তার নিষ্ক্রিয়তার কারণ হিসেবে জয়নাল হাজারী গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা তাকে ফেনীর রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তিনি রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। ফের যদি দলীয় সভাপতি রাজনীতিতে সক্রিয় হতে বলেন, তাহলে আবার তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন। দল যদি নির্বাচনী কাজে মাঠে নামতে বলে, তিনি মাঠে নামবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া জয়নাল হাজারী ধানমন্ডির ফ্ল্যাটেই বেশির ভাগ সময় কাটান। সেখানে নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ‘হাজারিকা প্রতিদিন’ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তার চার-পাঁচজন ব্যক্তিগত কর্মচারীও থাকেন ওই ফ্ল্যাটে। আর নিরাপত্তার জন্য চারজন আনসার সদস্য আছেন। ২০১০ সাল থেকে এই নিরাপত্তা পাচ্ছেন তিনি।
হাজারিকা সম্পাদনা ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সব সময়ই সক্রিয় এই রাজনীতিক। মাসে দুবার ফেসবুক লাইভে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বক্তব্য দেন তিনি। সেখানে ফেনীর রাজনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও কথা বলেন। আর তার অবসর কাটে লেখালেখি করে, ইন্টারনেট আর ক্রিকেট খেলা দেখে।
এখন আর খুব বেশি নিজ শহরে যাওয়া হয় না ফেনীর স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতির। দীর্ঘ দুই বছর পর গত মাসের ২৭ তারিখ ফেনী সফর করেন তিনি। বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করে ওই দিনই আবার ঢাকায় ফিরে আসেন।