মোহাম্মদ ইউসুফ
……………………………..
বাংলাদেশে মোট সরকারি শিশু সদনের সংখ্যা ৮৫ টি। সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসব শিশু সদনে সরকারি সুযোগ-সুবিধায় গড়ে প্রায় ১০০ জন শিশুর থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে অবস্থানকারী শিশুদের বয়স ৬ থেকে ১৮ বছর। এসব শিশুদের বেশীর ভাগেরই বাব-মা নেই কিংবা অনেকের থেকেও নেই।
শিশুরা এখানে আবাসিকভাবে অবস্থান করে পার্শ্ববর্তী স্কুলে সরকারি খরচে লেখা পড়া করে। গতানুগতিক লেখা পড়ার মাধ্যমে কেউ কেউ হয়তো বড়জোর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত যেতে পারে, এর বেশী সম্ভবত নয়। বেশীর ভাগই মাধ্যমিকের গন্ডি পার হতে পারেনা। বয়স ১৮ বছর পার হলে এখানে থাকার সুযোগ নেই বিধায় শিশুরা অন্যত্র গিয়ে যে যার মতো জীবিকা নির্বাহ করে। বেশীর ভাগই দিন মজুর, রিকসা-ভ্যান চালকের কাজ করে কিংবা শহরে গিয়ে খুব কম পারিশ্রমিকে পোশাক কারখানায় নিয়োজিত হয়।
অভিভাবকহীন বিধায় এদের একটি বড় অংশ সমাজে নেতিবাচক কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়ে, যা সামাজিক অবক্ষয়েরও একটি প্রধান কারন। আমাদের দেশের শিক্ষার একটি দূর্বল দিক হলো বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তা সার্টিফিকেট নির্ভর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিয়ে পাস করে বের হয় ঠিকই কিন্তু তার শতকরা কত অংশ যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারে তা বলাই বাহুল্য। কোন দেশ বা জাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন নির্ভর করে সে দেশ বা জাতির শিশুদের মেধাকে কাজে লাগানোর উপর। যে দেশ যত বেশী শিশুদের মেধাকে কাজে লাগাতে পেরেছে সে দেশ তত বেশী সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে উন্নতি লাভ করেছে। অন্যান্য দেশের চেয়ে আমরা প্রাকৃতিক ভাবে অনেক সৌভাগ্যবান যে আমাদের দেশে যত সংখ্যক শিশু রয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশে সে পরিমাণ জনসংখ্যাও নেই। ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি।
শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত এবং আলোকবর্তিকা, সার্বিক উন্নয়নের জন্য এদের মেধাকে সঠিক ভাবে কাজে লাগানোর কোন বিকল্প নেই। সে ধরনেরই একটি স্থান হচ্ছে জেলা কিংবা বিভাগীয় শহরে অবস্থিত সরকারি শিশু সদন সমূহ। এ সকল শিশু সদনের কার্যক্রম যেভাবে চলছে,তার সাথে অন্যান্য কৃষি-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অতি কম খরচে বেশ বড় কিছুর সংযোজন করা যায়, আর তা হচ্ছে আধুনিক কৃষি-প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞান ও তার ব্যবহার। কৃষি-প্রযুক্তির প্রশিক্ষনের জন্য প্রধান যে তিন টি জিনিষ দরকার তা হচ্ছে শিশুদের উর্বর মস্তিষ্ক, অবকাঠামোগত সুবিধা এবং হাতে কলমে শেখার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমান জমি, পুকুর ইত্যাদি, এর সব কটিই সরকারি শিশু সদসগুলোতে রয়েছে। আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক কারিগরী ও কৃষি-প্রযুক্তি ইনষ্টিটিউট রয়েছে যেখানে শেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী পাওয়া যায়না কারন সেখানে শিক্ষার্থীদের ভর্তির প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই কিংবা আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই।
কিন্তু এখানে প্রস্তাবিত বিষয়ে কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রয়োজন নেই।
একটি কর্মমুখী কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে সরকারকে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়, অথচ সরকারি শিশু সদনের অবকাঠামোগত ও শিক্ষার্থী সুবিধা নিয়ে যে বাস্তব ও কর্মমূখী প্রশিক্ষণ প্রদান করা যাবে যা কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো অংশেই কম হবে না বরং বেশী।
কারন, এখানে পৃঁথিগত শিক্ষা থাকবে ২০% এবং প্রায়োগিক শিক্ষা থাকবে বাকী ৮০%। এ ধরনের কাজে বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রয়োজন হবে প্রতিটি সরকারী শিশু সদনের জন্য কৃষি, মৎস ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ের উপর ২ জন করে ডিপ্লোমা ডিগ্রী ধারী অভিজ্ঞ লোক, ২ থেকে ৩ টি শিশু সদনের জন্য উল্লেখিত বিষয় সমূহের উপর ১০ থেকে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ১ জন করে ¯œাতক ডিগ্রীধারী লোক, চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র-পাতি, কিছু প্রশিক্ষণ উপকরন এবং শিশুরা যেদিন প্রশিক্ষনে নিয়োজিত থাকবে সেদিন তাদের জন্য কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
একটি শিশু সদনে ১০০ জন শিশুর মধ্যে পাওয়া যাবে ৫০ জন শিশু যাদের বয়স ১২ বছরের উপরে এবং তাঁরা প্রশিক্ষণ গ্রহনে শারিরীক ভাবে সক্ষম। এ সকল শিশুদের যদি সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন দৈনিক ৩ ঘন্টা করে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তাহলে ৫ থেকে ৬ বছরে প্রতিটি শিশু কর্মমুখী, দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে এবং তাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র হবে সরকারি শিশু সদনের বিস্তীর্ণ এলাকা।
আমার জানা মতে, শিশু সদনের এ সকল জমি ও পুকুর লিজ দেওয়া হয়। লিজ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে অর্থ উপার্জন করেন, ৫০ টি শিশু প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে এর চেয়ে অনেক বেশী অর্থ কর্তৃপক্ষকে উপার্জন করে দিবে এবং প্রতিটি শিশু সদনের বিস্তীর্ণ এলাকা বিশাল বিশাল খামারে পরিনত হবে। এতিম শিশুদের দ্বারা গঠিত এধরনের সমৃদ্ধ খামার সকলের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরনীয় হয়ে উঠবে। শুধু মাত্র কৃষি ভিত্তিক শিক্ষাই নয় এখানে কম্পিউটারে কাজ শেখা এবং মোবাইল মেরামতের উপরও প্রশিক্ষণ প্রদান করার সুযোগ রয়েছে।
৫ থেকে ৬ বছরের এ প্রশিক্ষণ চক্রে শিশুরা ১২ বছর বয়সে প্রবেশ করবে এবং ১৮ বছর বয়সে একেক জন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত উৎপাদনকারী হিসেবে বেরিয়ে আসবে। এখানে উল্লেখ্য যে এ ধরনের উৎপাদনমূখী প্রশিক্ষণটির কারনে শিশুদের পার্শ্ববর্তী স্কুলে লেখা পড়ার কিছুতেই ব্যাঘাত ঘটবে না বরং উপজাত হিসেবে এ প্রশিক্ষণটি শিশু সদনের প্রধান কাজটির চেয়ে বেশী ফলদায়ক হবে। বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ।
এ ৩০ ভাগ পরিবারের শিশুর সংখ্যা দেশের মোট শিশুর প্রায় সর্বোচ্চ ৩০%। এই ৩০% শিশুর মেধা পারিবারিক ঐতিহ্য ও আর্থিক স্বচ্ছলতার কারনে বিকশিত হলেও অবশিষ্ট ৭০% শিশুর মেধা সঠিক ভাবে বিকশিত হচ্ছে না কিংবা আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। এখানেই আমাদের দৈন্যতা কিংবা সীমাবদ্ধতা। সরকারি শিশু সদনে অবস্থানকারী শিশুরা এই ৭০% এরই একটা বড় অংশ।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জনে এ জায়গাটিতে শক্তভাবে হাত দেওয়ার কোন বিকল্প নেই। যত বেশী সংখ্যক শিশুর মেধার ইতিবাচক স্ফুরন ঘটবে ততই আমাদের পক্ষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজতর হবে। এখানে উল্লেখিত কাজটির সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকার কিংবা দাতা সংস্থা সমূহ পরীক্ষামূলকভাবে ১০ থেকে ১৫ বছরের একটি প্রকল্প হাতে নিলে তার সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে নিম্মরুপঃ
*সরকারি সম্পত্তি ও সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
*অবহেলিত ও প্রান্তিক শিশুদের মেধার বিকাশ ঘটবে।
* প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রতিটি শিশু একেক জন উদ্যোক্তা হিসেবে বেরিয়ে আসবে।
*দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরীর অবস্থান ত্বরান্¦িত হবে।
*সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরো সূদৃঢ় হবে।
*রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজারে অসামাজিক কাজের প্রকোপ কমে আসবে।
*নেশা কিংবা মাদকাসক্তদের সংখ্যা বহুলাংশে কমে আসবে।
*স্থানীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরন ত্বরান্বিত হবে।
* এসব অবহেলিত শিশুদের একটি বড় অংশকে উন্নয়নের ¯মূল স্রোতে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।
শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার। আসুন আমরা এই কর্ণধারকে আরো দক্ষ ও যোগ্য করে তুলি। যা আমাদের স্বপ্নের দেশ গড়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
( মোহাম্মদ ইউসুফ,গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী)