পারিবারিক বন্ধন বা পারিবারিক সম্পর্ক শব্দগুলোতেই রয়েছে অসংখ্য ভালোবাসা ও দায়িত্ব কর্তব্য। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্ক বিষয়টি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন নিয়ম নীতির ওপর চলে আসছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম থেকে আজ বর্তমান পর্যন্ত শ্বশুর বাড়ি প্রতি যেসব দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে পালন করে আসছে। কিন্তু আপনি কি সঠিক ভাবে শ্বশুর বাড়ির প্রতি সকল দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করতে পারছেন? ছেলে বা মেয়ে উভয়ের শ্বশুর বাড়ির প্রতি যেসব দায়িত্ব পালন করা উচিত সে সকল বিষয়গুলো সম্পর্কে আপনি জানেন?
এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো পুত্রবধূ বা মেয়ের জামাই ও শ্বশুর শ্বাশুড়ির মধ্যে যে দায়িত্ব এবং কর্তব্য গুলো রয়েছে সেগুলো কখনো একপক্ষীয় নয়। মা বাবার প্রতি যেমন সন্তানের দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে, তেমনি শ্বশুর শ্বাশুড়ির ও তার পুত্রবধূর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। তবে মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব থেকে ভিন্ন। তাই যেকোনো সম্পর্কের মধ্যে উভয়ের দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে দিয়ে একটি সম্পর্ক সুন্দর হয়ে থাকে। একপক্ষীয় কোন সম্পর্ক টিকে থাকে না এবং সেই সম্পর্কগুলো খুব সহজেই ভেঙে যায়, সম্পর্ক গুলোর মধ্যে তিক্ততা চলে আসে। তাই সম্পর্ক গুলোকে সুন্দর করার জন্য প্রতিটি সম্পর্ককে উভয় দিক থেকেই সম্মান, ভালোবাসতে হবে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে।
শ্বশুর শাশুড়ি পারিবারিক সম্পর্ক
শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে পারিবারিক সম্পর্ক সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য একজন স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। কারণ প্রতিটি মানুষের সাথে মানুষের সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রতিটি মানুষেরই দায়িত্ব এবং কর্তব্য। ঠিক তেমনি শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করার উচিত। কারণ একজন স্ত্রী যদি মনে প্রানে তার শ্বশুরবাড়ির সকল সদস্যকে ভালোবাসেন এবং তাদের সেবা যত্ন করেন তাহলে তার জন্য কল্যাণ এবং সওয়াব অপেক্ষা করছে। তবে এই কাজটি অবশ্যই তাকে নিজে থেকে করতে হবে। শ্বশুর শ্বাশুড়ি প্রতি সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য একজন স্ত্রী হিসেবে পালন করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তাই পারিবারিক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করা উচিত।
তবে আমাদের সমাজের আবহমানকালের রীতি অনুসারে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি প্রতি সকল সেবা যত্ন এবং দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা উচিত বলে মনে করে। সামাজিক রীতি থেকে নিজেকে দূরে রেখে ইসলাম কি বলে সেদিকে নজর দেয়া উচিত। তবে সামাজিকভাবে একজন স্ত্রীর ওপর যে সকল দায়িত্ব কর্তব্য চাপিয়ে দেয়া হয় সেগুলোকে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত।
তাছাড়া শ্বশুর-শ্বাশুড়ির প্রতি সেবা যত্ন করা ইসলামের সাহাবায়ে কেরামের জীবনেও দেখা গিয়েছে। সুতরাং পারিবারিক বন্ধন সুন্দর করার জন্য এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলো প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য অবশ্যই প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির প্রতি ভালো ব্যবহার করা তাদের সেবা যত্ন করা এবং তাদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য গুলো পালন করা। তবে এই সকল বিষয়ে আইনগত কোন বাধ্যবাধকতা নেই এবং জোর করার মত কোন বিষয় নেই। এখানে সম্পূর্ণ দায়িত্ব হতে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে পারিবারিক সম্পর্ক সুন্দর গড়ে তোলা শ্রেয়।
শ্বশুরবাড়ির প্রতি যেসব দায়িত্ব আপনার পালন করা উচিত
ইতিমধ্যে অবশ্যই জেনেছি যে শ্বশুর বাড়ির দায়িত্ব ও কর্তব্য তাদের পুত্রবধূকে অবশ্যই করতে হবে এমন বিষয় নয়। তবে তিনি যদি তার নিজ মানবিক দিক থেকে এবং পারিবারিক শিক্ষা থেকে, নিজের নৈতিকতার দিক থেকে শ্বশুরবাড়ির প্রতি দায়িত্ব পালন করতে চান তাহলে সেটি তিনি করতে পারেন শ্বশুরবাড়ির প্রতি যেসব দায়িত্ব আপনার পালন করা উচিত সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-
- শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ির কাজে সাহায্য করা।
- শ্বশুরবাড়ির সকল ব্যক্তিদের সেবা যত্ন করা।
- শ্বশুরবাড়ির সকলের সাথে ভালো আচরণ করা।
- শ্বশুর শ্বাশুড়ি অসুস্থ হলে তাদের সেবা যত্ন করা।
- শ্বশুর শ্বাশুড়িকে সময়মতো ঔষধ সেবনে সাহায্য করা।
- শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করার জন্য তাদের সাথে ঘুরতে যাওয়া।
- শ্বশুর শ্বাশুড়ির মন খারাপ থাকলে বা তারা যদি মানসিক প্রেসারে থাকে তাহলে তাদেরকে মানসিকভাবে প্রশান্তি দেয়া।
- শ্বশুরবাড়ির কোন বিপদ হলে তাদের বিপদে পাশে থাকা। যদি আর্থিকভাবে থাকা যায় তাহলে অবশ্যই আর্থিকভাবে থাকা উচিত।
- শ্বশুরবাড়িতে স্পেশাল দিনগুলিতে তাদের পছন্দের খাবার রান্না করা এবং তাদেরকে স্পেশাল দিন পালনে সাহায্য করা। ইত্যাদি।
ছেলে হিসেবে শশুর বাড়ির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
আদিম কাল থেকে বা সামাজিক রীতিনীতি থেকে আমরা জেনে আসছি যে শ্বশুরবাড়ি মানেই হচ্ছে একটি মেয়ের বিয়ের পরবর্তী বাড়ি। কিন্তু বিপরীতে আমরা এটি ভুলে যাই যে একটি মেয়ের এবং ছেলের বিয়ের মধ্য দিয়ে যেমন করে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি তৈরি হয় ঠিক তেমনি ছেলের শ্বশুর বাড়ি তৈরি হয়। যদিও বা মেয়ে বিয়ের পর তার বরের সাথে শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করে তাই মেয়ের শ্বশুর বাড়ি চর্চা বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু বিপরীতে যে ছেলের শ্বশুর বাড়ি রয়েছে এবং সেই শ্বশুর বাড়ির প্রতি ছেলের দায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে সেগুলো অবশ্যই লক্ষ্য রাখা উচিত। মানবিক দিক থেকে যেমন একটি মেয়ে তার শ্বশুরবাড়ি সকল দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে অংশ নেয় ঠিক তেমনি ছেলেরও উচিত মানবিক দিক থেকে ছেলের শ্বশুর বাড়ির প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালনে অংশ নেয়া। ছেলে যেভাবে শ্বশুরবাড়ির দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে পারে-
- নিয়মিত ছেলের শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের খোঁজখবর নেওয়া এবং বিশেষ করে বউয়ের বাবা মায়ের খবর নেয়া উচিত।
- তারা যদি অসুস্থ হয় তাদের সুস্থতার জন্য প্রাথিমিক চিকিৎসা দেয়া এবং প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
- শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে মূল্যবান সময় কাটানো উচিত।
- শ্বশুর শ্বাশুড়ির কিছু প্রয়োজন হলে তা পূরণ করা উচিত।
- শ্বশুর বাড়ির সদস্যরা যদি কোন বিপদে পড়ে তাহলে তাদের বিপদে পাশে থাকা উচিত।
- আর্থিকভাবে শ্বশুরবাড়ি কোন সমস্যার পড়লে তাদেরকে সেই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আর্থিকভাবে পাশে থাকা উচিত।
সুতরাং এভাবেই একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে শ্বশুর বাড়ির প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করতে পারে তাদের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা সম্পর্কে ইসলামিক মতবাদ
শ্বশুর শাশুড়ির সেবা সম্পর্কে ইসলামিক মতবাদ অনুসারে বিভিন্ন হাদিস অনুসরণ করা হয়। শ্বশুরবাড়ির সকল ব্যক্তিদের প্রতি যে কোন কাজে সহযোগিতা করা এবং তাদেরকে ভালোবাসা, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা স্ত্রীর নৈতিক কর্তব্য। কিন্তু বর্তমান সময়ে এ বিষয়গুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন এগুলো তার জীবনের অপরিহার্য কাজ। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় বিভিন্ন পরিবারের ছেলের বিয়ে দেয়া হয় শুধুমাত্র তাদের সেবার জন্য। এই সকল দৃষ্টিকোণ থেকে দূরে থাকা উচিত। ইসলামে এ ধরনের সম্পর্কের কোন ভিত্তি নেই। কারণ এই সম্পর্কে একটি হাদিসে রয়েছে যে, “মা-বাবার সেবা যত্ন করা হচ্ছে সন্তানের দায়িত্ব এটি কোনভাবেই পুত্রবধূর নয় ( আল বাহারুর রাইখঃ ৪/১৯৩ এবং কিফায়াতুল মুফতিল ৫/২৩০)।”
তবে কোন স্ত্রী যদি স্বামীর বাবা-মাকে নিজ কর্তব্য হতে অথবা সন্তুষ্ট হয়ে শ্বশুরবাড়ির সকল ব্যক্তিদেরকে সেবা করে তাহলে এটি সেই স্ত্রীর জন্য একটি প্রশংসনীয়। তবে কোনভাবেই তার ওপর চেপে দেয়া যাবে না। কারণ প্রতিটি সন্তান তার বাবা-মার প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করা উচিত। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি কোন শ্বশুর শ্বাশুড়িকে সেবা যত্ন করে তাহলে সেটার জন্য সে বিপুল পরিমাণে সওয়াব পাবেন। এবং আইনগতভাবেও শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সকল দায়িত্ব কর্তব্য অবশ্যই স্ত্রীকে পালন করতে হবে এ ধরনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
FAQ
শ্বশুরশাশুড়ির সাথে পুত্রবধূর সম্পর্ক কিভাবে সুন্দর হয়ে ওঠে?
শ্বশুর শাশুড়ির সাথে পুত্রবধূর সম্পর্ক উভয়পক্ষের সুন্দর আচরণ এবং দায়িত্ব-কর্তব্য এর উপর নির্ভর করে সম্পর্ক সুন্দর হয়ে ওঠে।
একটি মেয়ের শ্বশুর বাড়ির প্রতি যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে ঠিক তেমনি একটি ছেলের কিরূপ শ্বশুরবাড়ির প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য থাকে?
একটি মেয়ের যেমন শ্বশুরবাড়ির প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য থাকে ঠিক তেমনি একটি ছেলের শ্বশুর বাড়ির প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য থাকে না। তবে সে যদি দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে তাহলে সেটি পরিবার, সমাজ এবং ইসলামিক দিক থেকে ভাল কাজ হবে। কারণ উভয়ই ব্যক্তির বাবা-মা প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উচিত।
ইসলাম শ্বশুরবাড়ির প্রতি সেবা সম্পর্কে কি বলেছে?
ইসলাম বিভিন্ন হাদিসে শ্বশুরবাড়ির প্রতি সেবা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস রয়েছে। যেগুলো প্রত্যেক মুসলিমদের মেনে চলা উচিত এবং এর ফলে পরিবারের শান্তি ফিরে আসে।
শেষ কথা
পরিশেষে, পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় শিক্ষার ওপর সকল ব্যক্তির আচরণগত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। তাই নিজের বাবা মার প্রতি যে সকল দায়িত্ব-কর্তব্য একজন সন্তান হিসেবে করা উচিত ঠিক তেমনি শ্বশুর বাড়ির প্রতি ছেলে মেয়ে উভয়ের-ই যেসব দায়িত্ব আপনার পালন করা উচিত সেগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়া। কারণ সামাজিক রীতিনীতি বা পারিবারিক রীতিনীতি অথবা ধর্মীয় অনুশাসন অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়।
আর বিবাহ এই বন্ধনের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সুন্দর কিছু সম্পর্ক এবং পাওয়া যায় নতুন একটি বাড়ি। আর সে বাড়ির সকলকে নিজের আপন করে নিতে হয়। সুতরাং একজন মানুষ হিসেবে সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে সকলের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা উচিত। তবে আপনি যদি যেকোনো সম্পর্কের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করা সম্পর্কিত তথ্য জানতে চাইলে কমেন্ট করতে পারেন।