কাওয়ালির কিংবদন্তি নুসরাত ফতেহ আলী

ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৮
Spread the love

বিশেষ প্রতিবেদক

গেল সত্তুরের  দশকের শেষ ভাগে বলতে গেলে আকষ্মিকভাবেই   আবির্ভাব তাঁর। তিনি পাকিস্তানের কাওয়ালিশিল্পী নুসরাত ফতেহ আলি খান।  আবির্ভাবের কয়ে বছরের মধ্পয্বেই বিশ্ব সংগীত পিপাসুরা টের পেয়েছিল অনন্য প্রতিভার গুণাবলী। ফলে  কয়েক বছর যেতে না যেতেই তিনি পরিণত হন বিশ্বসঙ্গীতে তারকায়। তাঁকে বলা হয় কাওয়ালির রাজা।  

কীভাবে এতো দ্রুত  তাঁর আত্মপ্রকাশ আর কি করেই বা  এতো  খ্যাতি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল সে কথা অনেকেরই অজানা। 

কাওয়ালির এক ভবিষ্যৎ তারকা  নুসরাত ফতেহ আলি খান- এই  সম্ভাবনার কথা  প্রথম টের  পেয়েছিলে বার্মিহাম শহরের  রেকর্ড ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আইউব। বামিংহামে  তাঁর একটি দোকান ছিল  যেখানে তিনি   এশিয়ান শিল্লীদের গানের  রেকর্ড প্রকাশ করতেন।  ১৯৭৭ সালের কথা।  একদিন সকালে আউউবের  হাতে পৌঁছায়  বেশকিছু  টেপ। যেগুলোতে ছিল   পাকিস্তানের কিছু নবীন শিল্পীদের গান।  আইউব  যখন সেসব নবীর শিলাপীদের রেকর্গুডগুলো  শুনতে বসলেন তখন  একটি  বিশেষ গান, একটি বিশেষ কণ্ঠ আইউবকে  চমকে দেয়।

“আমার মনে হলো, এ কি – এ যে এক দেবদূতের কণ্ঠ। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। এমনি উঁচু পর্দার, মিষ্টি আর নেশা-ধরানো আওয়াজ তার। আমরা শুনেই যাচ্ছি, শুনেই যাচ্ছি – আর সেই কণ্ঠস্বর যেন আমাদের আরো বেশি করে পেয়ে বসছে।”

আইউবের মনে গেঁথে গেল সেই দরাজ কন্ঠ, সেই সুমিষ্ঠ গান।  আইউব বললেন, এটা ছিল আমার জন্য  এক অন্য রকম উপলব্ধি। আমি উপলব্ধি করলাম – আমরা  এর মধ্যদিয়ে  বিশ্বমানের কণ্ঠকে আবিষ্কার করে ফেলেছি, আমরা  সারা দুনিয়ায় তাঁকে  তুলে ধরবো।’

সেই কন্ঠ ছিল ওস্তাদ  নুসরাত ফতেহ আলির।   আইউব দেরি  না করে নুসরাতের  সঙ্গে  চুক্তি করে ফেলেন,  চারটি অ্যালবাম (ভলিউম) প্রকাশ করার জন্য।  

nusrat_fateh_ali_khan

নুসরাত ফতেহ আলি খানম যাঁর জন্ম পাকিস্তানের শিল্পনগরী ফয়সলাবাদে। ৩০০ বছর ধরে  তার পূর্বপুরুষরা কাওয়লি গায়ক।  কাওয়ালি হচ্ছে এক ধরণের ভক্তিমূলক  সুফি গান।  এর  উৎপত্তি হয়েছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইরান, ইরাক, ভারতবর্ষ থেকে।

  এরপর ১৯৮০ সালের  আইউবের সঙ্গে নুসরাতের প্রথম  মুখোমুখি সাক্ষাৎ ব্রিটেনে। 

আইউব বলেন,  নুসরাতকে আমরা  আমন্ত্রণ জানাই  ইংল্যান্ডে কিছু অনুষ্ঠান করতে। যার একটি অনুষ্ঠান ছিল বামিংহামে।

বার্মিংহ্যামের অনুষ্ঠানটিতে তেমন শ্রোতা সমাগম হয়নি।   হাজারখানেক লোকের আসন  এমন মিলনায়তনে শ্রোতা হাজির  হয়েছিলেন মাত্র ৫০- ৬০ জন। কারণ সেটা প্রচারের দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের ব্যর্থতার কারনেই হয়েছিল।   কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে গান  শুনে আমার মনে হয়েছিল এখানে আরও অনেক বেশি শ্রোতা আসা  উচিত ছিল।

এবার আইউব ঠিক করলেন, তাঁরা নিজেরাই পরের সপ্তাহে নুসরাতের র আরেকটি অনুষ্ঠান আয়োজন করবেন। সেটাই  হল। আর সেই অনুষ্ঠানটির পক্ষে   খুব ভাল  প্রচারও চালান।

দেখা গেল, দ্বিতীয় অনুষ্ঠানের  সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। মিলনায়তন এমনভাবে ভরে যায়  যে সবাই বসার সেখানে সুযোগও পাননি। অনেকে  বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান শুনেছেন।  পরে  নুসরাতকে ব্রিটেনের  অন্য শহরগুলোয়  নিয়ে অনুষ্ঠান করলে সেখানে ভাল সাড়া মেলে।  

কিন্তু তখন্ও পর্যন্ত নুসরাতের  গান শুনেছিলেন কেবলই এশিয়ার শ্রোতারা। কিন্তু তার গন্ডি পার হল   ১৯৮৫ সালে।

৮৫-এর  গ্রীষ্মে এসেক্সে অনুষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ বিশ্বসংগীত উৎসব । সেই উৎসবে এক রাতে নুসরাত আর তার দল মঞ্চে উপস্থিত হলেন। বলা হয়, সেদিনের সেই অনুষ্ঠান নুসরাতের  সঙ্গীতজীবনের গতিধারাই  পাল্টে দেয়।

ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ব্যবস্থাপক  অ্যামান্ডা জোনস বলেন, সত্যি  এই রেকর্ড লেবেলটি চালু করেছিলেন ব্রিটিশ গায়ক পিটার গ্যাব্রিয়েল।  যিনি বেঁচে  নেই। তিনিই ছিলেন বিশ্বসংগীত উৎসবের  প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম।

nusrat_fateh_ali_khan

 পরবর্তীতে নুসরাতকে নিয়ে  সারা বিশ্বে যে মাতামাতি তৈরি হয়, তার সূচনা এসেক্সের মার্সি আইল্যান্ডের সেই ওম্যাড ফেস্টিভ্যাল থেকেই। 

সেই অনুষ্ঠানের মঞ্চটি ছিল সাগড়পাড়ে।  ঠান্ডা বাতাস চারদিকে । নুসরাতের র পা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিল। অস্বস্তি হওয়ায় নুসরাত বলছিলৈন , এ অবস্থায়  মঞ্চে গান গাইতে পারছেন না।    তাঁর জন্যে কম্বল, বালিশ আনা হল। তা  পায়ে জড়িয়ে দেওয়া হলো। চার পাশে দেওয়া হলো কয়েকটি হিটার। তার পর তিনি শুরু করলেন গাইতে ।  কি  যে  গাইলেন,  তা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য।  

 জোনস বলছিলেন,  সেখানে উপস্থিত শ্রোতাদের জন্য যেমন তেমনি নুসরাতের জন্যও এটা ছিল এক দুর্দান্ত মুহূর্ত।  তিনি হয়তো  তা নিজেও বুঝতে পারছিলেন।  বুঝতে পারছিলেন তাঁর  সংগীত ও গায়কী সম্মোহনী শক্তি কতটা প্রখর।  শ্রোতারা তাঁর গানের একটি কথাও বুঝতে পারছিল না – অথচ তাদের মনের ওপর তা কত বড়  প্রভাব ফেলছে। 

শ্মরোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলেন তাঁর গান। কেউ  নড়াচড়াও করতে পারেননি।   গাইবার কথা ছিল দেড় ঘন্টা। কিন্তু যখন তিনি যখন  গান শেষ করলেন তখন বাজে ভোর পাঁচটা।  দিনের আলো ফুটে গেছে।  

 কণ্ঠের সৌন্দর্য ছিল এতোটাই  বিস্ময়কর যা সবাই সন্মোহিত করতে পারত। এ ছিল যেমন আবেগময় আর নরম, অন্যদিকে তেমনি অবিশ্বাস্য রকমের শক্তিশালী এবং প্রখর   উচ্ছল। এরপর থেক্কেই সারা পৃথিবী চিনে যায় নুসরাত ফতেহ আলি খান নামে এই প্রতিভাকে।  

জাপানে তাঁর গান শুনতে আসতেন  তরুণেরা।  তাদের জিজ্ঞেস করলে ওই তরুণের বলেন, তোমরা কি তার গানের কথার অর্থ বুঝতে পারছো ? তারা বলে ‘না,  ওনার গানের কথা আমরা বুঝি না।  কিন্তু উনি যা গাইছিলেন তা আমাদের হৃদয ছুঁয়ে যাচ্ছিল। জাপানের মানুষ নুসরাতকে   তুলনা করতো   মহামতি গৌতম  বুদ্ধের সঙ্গে।”

 নুসরাত ফতেহ আলি  হলিউডের ছবিতেও গান গান। ভারতীয় একজন প্রযোজকের সঙ্গে মিলে তিনি কাওয়ালি নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কিছু কাজেও হাত দিলেন। তিনি কাওয়ালির সঙ্গে পশ্চিমা  সংগীতের সংমিশ্রণ ঘটান। এর মধ্যে গিটারিস্ট মাইকেল ব্রুকের সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত অ্যালবাম হয় ।

অনেকে  মনে করেন এই অ্যালবামের ফলে   কাওয়ালি  নতুন জীবন পায়, এটা ছিল কাওয়ালির নতুন ধারার সূচনা। ।  এর ফলে  তরুণ প্রজন্মের কাছে  বিপুল জনপ্রিয়তা পায় কাওয়ালি ।

nusrat_fateh_ali_khan 

তবে নুসরাত বিকৃতিতে গা ভাসাননি। ছাড়েননি  ঐতিহ্যের পথ।  ধ্রুপদী কাওয়ালিই ছিল  পছন্দ। কিন্তু তিনি নতুন কিছু করার প্রয়োজন মেনে নিয়েছিলেন বিনা প্রশ্নে।েআর এ জন্য নুসরাত  বলতেন,  নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে এবং থাকবে। ভবিষ্যতের জন্যই এই নিরীক্ষা প্রয়োজন। এসঙ্গীতকেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে  পরিবর্তিত হতে হয়।  

 এসব নিরীক্ষাকে অনেকে   ঐতিহ্যবিরোধী ভাবতে পারেন।  নতুন কিছু করার পক্ষে  এটা অভিনব এবং সৃষ্টিশীল বিষয়।  নুসরাত ব্যাপারটা উপভোগ করতেন এবং সংগীতকে তিনি  এক ভিন্ন কাঠামোর মধ্যে ফেলে  নতুনত্ব আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।  তবে নুসরাতের জীবনযাত্রার প্রভাব তাঁর শরীরের ওপর পুরোপুরি পড়েছিল। খুব  ওজন  এবং স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যাও  দেখা দেয় তাঁর। এজন্য  ১৯৯৭ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়েসে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর এমন অকাল  মৃত্যু কেবল পাকিস্তানই নয় সারা পৃথিবীর নানা দেশের মানুষের কাছে এক গভীর  শূন্যতা।   তিনি ছিলেন খুবই শান্ত এবং গম্ভীর প্রকৃতির । তাঁর মধ্যে সবসময়ই একটা স্থির এবং নিজের মধ্যে মগ্ন  থাকার ভাব-প্রবণতা ছিল।  

 গান গাওয়াটাই ছিল তাঁর জীবনের সব। আর এর মধ্যদিয়েই  নুসরাতের ভেতরের সত্ত্বাগত  শক্তি এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ পেত।  – যা তাঁর  শ্রোতাদের  বিপুল আলোড়িত ও  সম্মোহিত করতো।