অগ্নিযুগের বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ

জানুয়ারি ১০, ২০১৯
Spread the love

অনিন্দ্য আফরোজ

উপমহাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দেবেন্দ্র নাথ ঘোষ এক বিপ্লবী পুরুষের নাম। শৈশব থেকে আমৃত্যু যিনি সংগ্রাম করেছেন ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের  অপশাসনের বিরুদ্ধে। তিনি লড়াই করেছেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সকল সংগ্রামেও।  এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাতে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন সামরিক শাসক ৮৫ বছর বয়সে তাঁকে জেলে নিক্ষেপ করে।

ব্রিটিশ-পাকিস্তানের অন্যায়,অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে  এই মহা সংগ্রামী পুরুষকে জীবনের এক চতুর্থাংশ সময় অর্থ্যাৎ প্রায় ২৬ বছর কারাভোগ করতে হয়েছে।শুধুমাত্র সশস্ত্র সংগামের সংগঠক নয়; সমাজসেবা, কর্মনিষ্ঠা ও সততায় দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ আজও বাঙালীর কাছে এক অনন্য অনুপ্রেরণা ।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

১৮৯০ সালের ২২ এপ্রিল দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ বরিশাল নগরের কাউনিয়া ক্লাব রোডের নিজ বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমা- সে কারণেই বাবা নিবারণ ঘোষ ও মা রাজলক্ষ্মী ঘোষ আদর করে তার নাম রাখেন আবীর। পরবর্তীকালে এই আবীর সবাইকে আবীরে রাঙিয়েছিলেন। ছেলেবেলায় দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন জেদী স্বভাবের এবং তখন থেকেই নিরন্ন মানুষের প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। এমনও হয়েছে দুপুরে ভিখিরি এসে উঠোনে দাঁড়াতেই দেবেন্দ্রনাথ নিজের থালার ভাত ভিখিরিকে দিয়ে নিজে না খেয়ে থেকেছেন। আবার কোনোদিন নিজের গায়ের জামাটি গরীব বন্ধুকে দিয়ে অবলীলায় খালি গায়ে বাড়ি ফিরেছেন।

দেবেন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত প্রতিষ্ঠিত এবং তার সত্য প্রেম পবিত্রতার আলোকে উদ্ভাসিত ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে। বলতে গেলে দেবেন্দ্রনাথের ভবিষৎ আদর্শিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রস্তুতি পর্বের সূত্রপাত ঘটে এখানেই। স্কুল জীবনে ব্রিটিশ বিরোধিতার কারণে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তাঁকে সকল বিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ করে।

 

সংগ্রামী জীবনের সূচনা

১৯১৩ সালে ‘বরিশাল ষড়যন্ত্র’ মামলায় দেবেন্দ্রনাথ গ্রেপ্তার হন। শুরু হয় এই মামলার বিচার কাজ। বয়স কম হওয়ায় ওই মামলার বিচারে তাঁর দীপান্তর হয়নি। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বহু সংগ্রামী নেতার সান্নিধ্যে এনেছিলেন তিনি। ১৯০৫ সালে ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড কার্জন এবং বাংলার লর্ড ছিলেন ব্যামফিল্ড ফুলার। এই সময়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের সর্বত্র। বরিশালে এই ঢেউয়ের তোড় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কিশোর দেবেন্দ্রনাথকে। ১৯০৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের বরিশাল অধিবেশন ব্যারিষ্টার আবদুর রসুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকারের নির্যাতন ও দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে শামিল হলেন দেবেন। ১৯০৭ সালে বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ গুহ ও যতীন্দ্র নাথ দাসের অনুপ্রেরণায় ভীম বন্দ্যোপাধ্যায়, ফেগু রায়, অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন পাল, সুবোধ মল্লিক, তারকনাথ দাস, মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পুলিন মিত্রের নেতৃত্বে সদ্য কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন বিপ্লবী অনুশীলন দলে যোগ দেন দেবেন্দ্রনাথ।

বরিশালে তখন অনুশীলন দলের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি ছিল। বাহ্যিকভাবে অনুশীলন দলের কর্মকাণ্ড শরীর চর্চা, লাঠিখেলা, ছোরা খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ভেতরে ভেতরে চলত অস্ত্রশিক্ষা ও সামরিক প্রশিক্ষণ। অনুশীলন দলের একটি গোপন ঘাঁটি ছিল তখন বরিশাল নগরের বাজার রোডের মুদী খানার পেছনে। আমানতগঞ্জের পানির কল এলাকা তখন ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। এখানেও অনুশীলন দলের গোপন ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটির নেতৃত্ব দিতেন ইঞ্জিনিয়ার সুনীল ঘোষ এবং ওভারশিয়ার শশাঙ্ক ঘোষ। বাজার রোড বিস্ফোরণের কারণে হাসপাতাল রোডের ‘বেঙ্গল বোর্ডিং’ থেকে পুলিশ চন্ডী বসুকে ধরে নিয়ে যায়। নিজের বাড়ি থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ এবং গোপাল মুখার্জীর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন রমেশ আচার্য। তখন ব্রিটিশ সরকার এই বিপ্লবীদের নামে যে মামলা করেন তাই বিখ্যাত ‘বরিশাল ষড়যন্ত্র’ মামলা নামে ইতিহাসে খ্যাত।

বৃটিশের বিরুদ্ধে এটাই ছিল প্রথম ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা। এই মামলার অভিযোগে বলা হয়, সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আশ্রয় করে ব্রিটিশ সরকারকে এরা খতম করতে চেয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়ে আসার আগ পর্যন্ত-দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় যদুনাথ কুশারীর ওপর। ১৯১৯ সালে জালিওয়ানাবাগের নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য দেবেন্দ্রনাথ এবার কলকাতায় চলে যান। ১৯২৫ সালে তিনি আবার বরিশালে ফিরে এসে নিজ ব্যায়ামরুর নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সূর্যকান্ত ব্যায়াম বিদ্যালয়’ যা বর্তমানে কাউনিয়া ক্লাব নামে পরিচিত।

১৯২৬ সালে বরিশাল কৃষি প্রদর্শনীর নামে জুয়া খেলা এবং কুলকাঠী গ্রামে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট বান্ডির নির্দেশে মুসলিম হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান দেবেন্দ্রনাথ। ১৯২৮ সালে অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দল একীভূত হয়। এই সময় দেবেন্দ্রনাথ আরএসপিতে যোগ দেন। তার এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তারই ভাইপো দেব কুমার ঘোষ (মনাদা)।

 ১৯২৯ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হন তিনি। ১৯৩০ সালে বরিশালে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নায়ক মাস্টার দা সূর্য সেন ও তাঁর সঙ্গী বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তিনি আবারো  গ্রেপ্তার হন। ১৯৩১ সালে বারাসাত জেল থেকে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার জেলে স্থানান্তর করে তাঁকে ভিলেজ ডেটিনিউ হিসেবে আটক রাখা হয়। এর পর ছাড়া পেয়ে বাঁকুড়া থেকে তিনি বরিশালে ফিরে আসতেই  আবার ১৯৩৩ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেলে পাঠানো হয়। সেখান থেকে রাজপুতানার দেউলী জেলে। জেলে জেলে ঘুরতে থাকে তার জীবনচক্র। ১৯৩৪ সালে জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে এবং তা বিলোপ হবার লক্ষ্যে ফ্লাউড কমিশনে সাক্ষ্য দেন দেবেন্দ্রনাথ। ১৯৪০ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের আগমন কর্মসূচিকে সফল করার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ভূমিকা পালন করেন তিনি। এই কর্মসূচিতে তাঁর সহযোগী ছিলেন শহীদ হীরালাল দাশগুপ্ত। এরপর তিনি গ্রেপ্তার হয়ে  পাঁচ বছর কারাবন্দী ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ রাজ বিদায় নেওয়ার সময় তিনি জেল থেকে মুক্তি পান এবং সর্বোদয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে বরিশাল জেলার দায়িত্ব পালন করেন।

 ১৯৪৮ সালে ‘যুব সংঘ’ গঠন করে একই সঙ্গে দুর্ভিক্ষ মোচন ও কালোবাজারী দমনে মাঠে নামেন তিনি। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে দাঙ্গা বিরোধী ভূমিকা রাখায় তাঁকে পাকিস্তান সরকার নিরাপত্তাবন্দীর নামে আটক করে। ১৯৫১ সালে স্থানীয়ভাবে সংগ্রাম কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন।

কুমিল্লায় সর্বদলীয় সম্মেলনের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এর উদ্যোক্তা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথই। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে অন্য প্রার্থীকে পরাজিত করে দেবেন্দ্রনাথ ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও শরীক হন দেবেন্দ্রনাথ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেবেন্দ্রনাথকে দেশরক্ষা আইনে বন্দী করা হয়। এক বছর পরে মুক্তি পেয়ে দেবেন্দ্রনাথ বঙ্গবন্ধুর প্রণীত ছয় দফা বাস্তবায়নের আন্দোলনে যোগ দেন এবং ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখানে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭১ সালে দেশ শত্রমুক্ত হলে তিনি বরিশালে ফিরে আসেন এবং বরিশালে পুনরায় রাজনৈতিক ও সামাজিক তৎপরতা শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগ দেন এবং বরিশাল জেলা বাকশালের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।পরবর্তীতে তিনি জেলা গভর্ণরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারের হত্যাযজ্ঞের পরপরই তাকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। প্রায় ১ বছর তিনি কারাভোগ করে ছাড়া পান। এরপর বৃদ্ধ বয়সেও ৯০ এর পরবর্তী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সামাজিক সকল কর্মকাণ্ড থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। সামরিক শাসন ও স্বৈরচারদের বিরুদ্ধে যখন কেউ কথা বলতেন না তখন তিনি নিশ্চুপ থাকতে পারতেন না। শান্ত স্বভাবের এই মানুষটিই হয়ে উঠতেন সংশপ্তক। একাধারে তিনটি রাষ্ট্রের জেল জীবন ভোগ করে তিনি হয়েছিলেন ওঠেছিলেন সংগ্রামী পুরুষ। ১৯৯৯ সালের ১১ জানুয়ারি এই মহাপ্রাণ সংগ্রামী পুরুষের জীবনাবসান ঘটে।