আয়না২৪ ডেস্ক
ইতিহাস গড়া হল না হিলারি ক্লিন্টনের। আধুনিক বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্রের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ আটকে দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
অথচ ভোটের আগে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও এগিয়ে ছিলেন হিলারিই। শেষ দিন পর্যন্ত বেশির ভাগ জনমত সমীক্ষাই বলছিল হিলারি জিতছেন। কয়েকটি সমীক্ষা তো হিলারিকে প্রায় চার শতাংশ এগিয়ে রেখেছিল। ভোটের আগে শেষ মুহূর্তে এফবিআই-এর ঘোষণায় বাড়তি স্বস্তিও পেয়েছিলেন হিলারি। দেশের গণমাধ্যমের বড় অংশ সঙ্গে ছিল তাঁর। এমনকী রিপাবলিকান নেতাদেরও একটি অংশ প্রকাশ্যে তাঁকে সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন। তাঁর হয়ে জোর কদমে প্রচারে নেমেছিলেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। হলিউডের নামকরা সেলিব্রিটিরাও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তার পরেও সব হিসেবকে ভুল প্রমাণিত করে হিলারি হেরে গেলেন। বিদ্বেষ, বিতর্ক, যৌন হেনস্থার একের পর এক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকায় ফিরল রিপাবলিকান শাসন।
জনমত সমীক্ষায় আস্থা রাখা ভোট-পণ্ডিতরা মনে করছিলেন ফল বেরনোর পরে রিপাবলিকান পরিবারে টালমাটাল উঠবে। হারের কারণ নয়, কী ভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান প্রার্থী হলেন তাই নিয়েই চর্চা শুরু হবে। ফল বেরনোর পরে আলোচনা শুরু হল। শুরু হল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে। সেই আলোচনার উৎস ফলাফলের সংখ্যাতাত্ত্বিক আলোচনা। সেই সংখ্যার দিকে তাকালে হিলারির হারের কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আফ্রিকান-আমেরিকান, স্প্যানিশভাষী ল্যাটিনোস, মহিলা, কলেজ শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ যুবক-যুবতী— ভোটারদের চারটি অংশকে ধরে প্রেসিডেন্ট পদে বসতে চেয়েছিলেন হিলারি। ওবামার পর পর দু’বার জয়ের পিছনে মার্কিন ভোটাদের এই চারটি অংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু ফল বলছে এই চারটি অংশের কাছ থেকেই প্রত্যাশিত সমর্থন পাননি হিলারি।
যেমন আফ্রিকা-আমেরিকানদের মধ্যে বরাবরই জনপ্রিয় ওবামা। সেই জনপ্রিয়তার জোয়ারে তরী ভাসাতে চেয়েছিলেন হিলারি। তরী ভেসেছে। কিন্তু যে বেগে চললে ওভাল অফিসে পৌঁছনো যায় তা আসেনি। ভোটারদের এই অংশ থেকে ২০১২ সালে ওবামার জুটেছিল ৯৩ শতাংশ ভোট। হিলারির ঝুলিতে এসেছে ৮৮ শতাংশ। এটি ট্রাম্পের ৮ শতাংশের তুলনায় বিপুল হলেও শ্বেতাঙ্গ, কলেজে পড়েনি এমন ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের জোয়ারকে আটকানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। একই কথা বলা যায় ল্যাটিনো ভোটকে নিয়েও। ২০১২তে ল্যাটিনো ভোটের ৭১ শতাংশ পেয়েছিলেন ওবামা। হিলারির ক্ষেত্রে তা নেমে গিয়েছে ৬৫ শতাংশে।
পাশাপাশি এই প্রথম কোনও মহিলাকে প্রেসিডেন্ট করার জন্য সে ভাবে কিন্তু মহিলারা এগিয়ে এলেন না। ওবামা ২০১২তে মহিলাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। হিলারির জুটেছে ৫৪ শতাংশ।
কিন্তু হিলারির মূল ধাক্কা এসেছে কলেজ পড়ুয়া কম বয়সীদের কাছ থেকে। নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্পের বক্রোক্তি, বিদ্বেষ এই অংশটিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল বলে অনেকে মনে করছিলেন। হিলারিও এঁদের কাছে টানার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল ২০১২তে ওবামা যেখানে এই অংশের থেকে ৬০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন হিলারির জুটেছে মাত্র ৫৪ শতাংশ। কেন এমন হল? অনেকের মতে এই অংসের মধ্যে হিলারি নন, প্রবল ভাবে জনপ্রিয় ছিলেন বার্নি স্যান্ডার্স। ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী বাছাইয়ের লড়াইয়ে (প্রাইমারি) হিলারির সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল বার্নির। দেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্নির বাম ঘেঁষা চিন্তাভাবনা ব্যপক জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই বার্নিকে শেষ পর্যন্ত হিলারির কাছে হারতে হয়। পরে দেখা যায় হিলারিকে ডোমোক্র্যাট প্রার্থী করার সেই প্রক্রিয়াটিতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। ফাঁস হয়ে যাওয়া ই-মেল প্রমাণ করে কী ভাবে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমভেনশন (ডিএনসি)-এ হিলারির জন্য ঘুঁটি সাজানো হয়েছিল। এই অংশটি হিলারির পিছনে সে ভাবে দাঁড়ায়নি। অনেকের সন্দেহ ট্রাম্পকে তীব্র অপচ্ছন্দ করলেও অনেক ডেমোক্র্যাট ভোটার বুথ মুখো হননি। যা ডেমোক্র্যাটদের ধারাবাহিক ভাবে জেতা বেশ কিছু প্রদেশে এ বার ট্রাম্পকে জিতিয়েছে।
পাশাপাশি উঠে এসেছে ডেমোক্র্যাটদের চিরাচরিত ভোটব্যাঙ্ক শ্রমিক শ্রেণি। মার্কিন উৎপাদন শিল্পের মন্দাকে কাজে লাগিয়ে ট্রাম্প এঁদের মনে আউটসোর্সিং, মুক্ত বাণিজ্যের ভয় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। কাজ হারানোর ফলে বা হারানোর আশঙ্কায় এঁদের একটি অংশ ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছে বলেও মনে হচ্ছে। পাশাপাশি চিরাচরিত রিপাবলিকান ভোটদের বুথমুখী করতে পেরেছেন ট্রাম্প। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ, সমকামীদের অধিকার, ইরান ও কিউবার সঙ্গে নতুন সম্পর্ক— ওবামার বেশ কিছু নীতির এঁরা প্রবল বিরোধী। ব্যালটে সেই বিরোধিতার স্বাক্ষর রেখে ট্রাম্পকে আগামী চার বছরের জন্য ওভাল অফিসে থাকা নিশ্চিত করেছেন তাঁরা।
আরও একটা হিসেব সম্ভবত বুঝে উঠতে পারেননি ভোট সমীক্ষকরা। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ ভোট অধিকাংশ গেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে। কোথাও কোথাও হিলারির সঙ্গে তাঁর ফারাক দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশেরও উপরে।
ট্রাম্প তো জিতলেনই, একই সঙ্গে মার্কিন সেনেট এবং মার্কিন কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পেয়ে গেল রিপাবলিকানরা।