বেনজির ভিডিও প্রকাশ করল চিন। পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) অধীনে গঠিত নতুন বাহিনী ‘রকেট ফোর্স’ বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র সাজিয়ে যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রস্তুত— অনেকটা এমনই বার্তা দেওয়া হল ভিডিওয়। বিশেষজ্ঞরা অন্তত তেমনই মনে করছেন। এ ধরনের ভিডিও চিন আগে কখনও প্রকাশ করেনি। ডংফেং-১৬ ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে চিনা সেনার মহড়ার এই ভিডিও আসলে ভারত, জাপান এবং আমেরিকার প্রতি চিনের হুঁশিয়ারি, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশারদদের বড় অংশই।
চিনের হাতে সুদীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অনেক দিন ধরেই রয়েছে। স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। কিন্তু মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল চিনা সেনার অস্ত্রাগারে সে ভাবে ছিল না। কৌশলগত ভাবে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বেশ কিছু বছর ধরেই চিন মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে জোর দিচ্ছিল। ১০০০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম ডংফেং-১৬ সেই গোত্রেরই ক্ষেপণাস্ত্র। অনেকগুলি ডংফেং-১৬ নিয়ে মহড়া দেওয়ার ভিডিও প্রকাশ করে চিনা সেনা বুঝিয়ে দিল, যথেষ্ট সংখ্যক মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রও এসে গিয়েছে তাদের অস্ত্রাগারে।
চাপে পড়েছে বলেই চিন নিজের পেশি দেখাতে চাইছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
এমনিতে নিজেদের অস্ত্র ভাণ্ডারের তথ্য প্রকাশের প্রশ্নে চিন অত্যন্ত রক্ষণশীল। নিজেদের অস্ত্রাগারে ঠিক কী কী অস্ত্র রয়েছে, কোন অস্ত্রের সক্ষমতা কী রকম, সে সব বিষয়ে বিশদ তথ্য চিন কিছুতেই প্রকাশ করে না। চিনা সেনা দেশের ভিতরে কোথায়, কী ধরনের মহড়া বা প্রশিক্ষণে অংশ নেয়, সে তথ্য তো আরও বেশি করে গোপন রাখা হয়। কিন্তু চিনের ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনী ‘রকেট ফোর্সে’ কী ভাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং কোন কোন ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার মহড়া দিচ্ছে, ভিডিও ছেড়ে সে তথ্য চিন গোটা বিশ্বের সামনে প্রকাশ করায় বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বেশ বিস্মিত।
যে ভিডিও চিনা সেনা প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, অনেকগুলি লঞ্চ ভেহিকলে করে প্রচুর পরিমাণে ডংফেং-১৬ ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে এগোচ্ছে পিএলএ রকেট ফোর্স। খুব দ্রুত মোবাইল লঞ্চারে
ক্ষেপণাস্ত্র লোড করা হচ্ছে, ততোধিক দ্রুততায় লঞ্চারকে এক স্থান থেকে সরিয়ে অন্যত্র মোতায়েন করা হচ্ছে এবং প্রয়োজন মতো লঞ্চ সিকোয়েন্স বা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের বিন্যাস বদলানো হচ্ছে। চিনের সরকার চালিত সংবাদপত্র ‘চায়না ডেইলি’তে সোমবার লেখা হয়েছে, রকেট ফোর্স শুধু ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার মহড়াই দেয়নি, আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল প্রয়োগ করে দেখিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর যে রাসায়নিক এবং জৈবিক দূষণ ঘটে, খুব দ্রুত তা প্রশমিত করায় বাহিনী নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে বলে চিনা সংবাদপত্রের দাবি। এ ছাড়া, উপগ্রহের চোখকে ফাঁকি দেওয়া, প্রতিপক্ষের ইলেকট্রনিক জ্যামিংকে অকেজো করে দেওয়ার পরীক্ষাতেও রকেট ফোর্সের বিভিন্ন বিভাগ সফল ভাবে উতরে গিয়েছে বলে সেখানে লেখা হয়েছে। যে ভিডিওটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কোনও ফুটেজ অবশ্য নেই।
রুশ সীমান্তের কাছেও চিন ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। রাশিয়ার দাবি, সে ক্ষেপণাস্ত্র আমেরিকার দিকে তাক করা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মহল বলছে, চিনের এই ভিডিও প্রকাশ আসলে ভারত, জাপান ও আমেরিকার উদ্দেশে বার্তা। ১০০০ কিলোমিটার পাল্লার ডংফেং-১৬ মিসাইলকে চিনের যে কোনও অঞ্চল থেকে নিক্ষেপ করা সম্ভব। তার সুবাদে ভারত, জাপান এবং আমেরিকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এই মিসাইলের নাগালের মধ্যে রয়েছে।
আমেরিকার সঙ্গে চিনের দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দিন ধরেই প্রকাশ্যে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমেরিকা আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে চিন সম্পর্কে। ফলে আমেরিকাকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিতে চিন এখন তৎপর। আর ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিরাট এলাকা জুড়ে চিন নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের যে চেষ্টা শুরু করেছে, ভারত ও জাপান সেই আধিপত্যের পথে প্রধান বাধা। তার উপরে এই দুই দেশ আবার আমেরিকার ঘোষিত মিত্রও। ফলে ভারত এবং জাপানকেও পেশি দেখাতে চাইছে বেজিং। বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদরা। তবে চিন প্রবল চাপে পড়েই ভিডিও প্রকাশের কৌশল নিল বলেও বিশেষজ্ঞদের মত। যে দেশ চিরকাল নিজেদের সামরিক কার্যকলাপ গোপন রাখার নীতিতেই বিশ্বাসী, তারা হঠাৎ আগ বাড়িয়ে গোটা বিশ্বের সামনে নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভারের ছবি দেখাতে গেল কেন, বিশেষজ্ঞরা সেই প্রশ্নই তুলছেন।