আয়না২৪ প্রতিবেদন
সুইজারল্যান্ডের বাণিজ্যিক ব্যাংকে (সুইসব্যাংক) বাংলাদেশিদের। ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানতের পরিমাণ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৫ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা ।
একই সময়ের ব্যবধানে উন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের, এমনকি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর আমানতের পরিমাণও কমেছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক’ (এসএনবি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সুইজারল্যান্ডের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অর্থ জমা রাখার ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকদের আস্থা ক্রমেই কমে আসছে। ফলে গত কয়েক বছর ধরে সুইস ব্যাংকে বিদেশিদের আমানতের পরিমাণ কমেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানতের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ আইন কঠোর করায় বিশ্বব্যাপী এখন কালো টাকার প্রবাহ কমতে শুরু করেছে। আইনের কারণে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও ব্যাংক পাচারকৃত সম্পদের তথ্য সংশ্লিষ্ট দেশের হাতে তুলে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে সুইস ব্যাংকও বিভিন্ন দেশকে তাদের দেশের ব্যাংকগুলোয় পাচার করা অর্থের তথ্য দিতে শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমেরিকা, কানাডা ও ভারতকে কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ থেকেও তাদের কাছে কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। তবে তা এখনো পাওয়া যায়নি। কিছু ব্যক্তির বিষয়ে তথ্য চাইলে তাদের নামে কিছুই পাওয়া যায়নি বলে জানায় সুইস ব্যাংক।
এ ছাড়া সুইস সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের দেশে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কর ফাঁকি দেওয়া অর্থ রাখার সুযোগ বন্ধ করে দেবে। এ বিষয়ে তারা ব্যাংকিং আইনও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব কারণে সুইস ব্যাংকে বিদেশিদের আমানতের পরিমাণ কমছে। কিন্তু এর পরও বিশ্বব্যাপী সম্পদ পাচারের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আর বাংলাদেশ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা টাকার একটি অংশ পাচার হয়ে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত হচ্ছে।
সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত দুই দশক ধরে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশি নাগরিকদের টাকা পাচারের পরিমাণ ক্রমেই বেড়েছে। মাঝে মধ্যে দু-এক বছর তা কমলেও গড়ে বেড়েছে।
২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশি নাগরিকদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা বা ৬৬ কোটি ২৫ সুইস ফ্রাঁ (সুইজারল্যান্ডের মুদ্রার নাম)। বর্তমানে প্রতি সুইস ফ্রাঁ বাংলাদেশের ৮৪ টাকার সমান (১.০৪ ডলার)। গত বছর প্রতি সুইস ফ্রাঁর সমান ছিল ৮৮ টাকা। ফলে ওই এক বছরে তাদের মুদ্রার মান কমেছে। এ কারণে টাকার হিসাবে পাচার করা অর্থের পরিমাণও কম-বেশি হয়।
২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা (বর্তমান মুদ্রা বিনিময় হারে ৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা), ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৪৫২ কোটি, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ২৭৩ কোটি, ২০১২ সালে ২ হাজার ১৪ কোটি, ২০১১ সালে ১ হাজার ৩৪০ কোটি, ২০১০ সালে ২ হাজার ৭৩ কোটি, ২০০৯ সালে ১ হাজার ৩১৯ কোটি, ২০০৭ সালে ২ হাজার ১৩৯ কোটি, ২০০৫ সালে ৮৫৬ কোটি, ২০০২ সালে ২৭৫ কোটি, ১৯৯৯ সালে ৩৮৭ কোটি এবং ১৯৯৬ সালে ৩৩৭ কোটি টাকা ছিল সুইস ব্যাংকে।
সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। তবে কোনো বাংলাদেশি তার নাগরিকত্ব গোপন রেখে টাকা জমা করে থাকলে তা এই হিসাবের বাইরে। কারণ হিসেবে এসব তথ্য নেই।
একই সঙ্গে অন্যান্য সম্পদ ও চিত্রকলা জমা হয়ে থাকলেও এর হিসাব প্রতিবেদনে নেই। তবে সামগ্রিকভাবে ২০১৬ সালে মোট আমানতের পরিমাণ কমেছে। আমানত রাখার ক্ষেত্রে এ বছরও প্রথম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য।
সুইস ব্যাংক প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে উন্নত দেশগুলো থেকে সুইস ব্যাংকে সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৫১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। (প্রতি সুইস ফ্রাঁ ৮৪ টাকা ০২ পয়সা হিসাবে)।২০১৫ সালে এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৬৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে উন্নত দেশগুলোর আমানতের পরিমাণ আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮২ হাজার ৫২৬ কোটি টাকায়। ইউরোপের দেশগুলো থেকে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে আমানতের পরিমাণ কমলেও ২০১৬ সালে বেড়েছে। ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকের ইউরোপের দেশগুলোর আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯০৮ কোটি টাকা। আর ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৫২ কোটি টাকায়।
অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ বাড়লেও কমেছে ২০১৬ সালে। হিসাব অনুসারে ২০১৪ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সুইস ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ছিল ৯ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ জমানোর পরিমাণ ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
জানা গেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকে টাকা জমানোর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। আর ২০১৬ সালে টাকা জমানোর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা।