ভয়ানক সময়ে উপনীত পৃথিবী!

ডিসেম্বর ৩, ২০১৬
Spread the love
মানুষ তো ভোট দিয়েই ফেললেন।  কিন্তু অভিজ্ঞরা কী করেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমরা কী ভাবব? এটা  কী জনপ্রিয়তার নির্জলা বিস্ফোরণ,  যেটা আসলে বাস্তবতাকে মেনে  নিতে পারেনি, অথবা আমরা কি তাঁদের এই পছন্দ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব আমরা!  আমি বলব, সেটা হলে আমরা ভয়ানক এক  ভুল করব।

এই ভোটের পেছনে মানুষের বিশ্বায়ন ও প্রাযুক্তিক বিকাশ নিয়ে যে উদ্বেগ ছিল, তা বোঝাই যায়। কারখানা স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাওয়ায় বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এর সঙ্গে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যে জন্য  মধ্যবিত্তেরা চাকরি হারানোর আশঙ্কাকে দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। তখন তাঁদের জন্য বাকি থাকবে শুধু অধিকতর সৃজনশীল ও তত্ত্বাবধানজনিত কাজগুলো, যেখানে তাঁদের আরও যত্নশীল হতে হবে।

এতে বৈষম্য আরও বাড়বেই। ইন্টারনেটের বিভিন্ন  মাধ্যমে অল্প কিছু মানুষকে নিয়োজিত করে প্রচুর মুনাফা করা সম্ভব হতে পারে, যার সিংহভাগ ভোগ করবে  সংখ্যাগরিষ্ঠ  দরিদ্র, মধ্যবিত্ত শ্রেণির  চেয়েও কম সংখ্যক ধনী মানুষ। কিন্তু এটা অনিবার্য, যা একই সঙ্গে অগ্রগতিও বলা যায়। কিন্তু এটা সামাজিকভাবে ধ্বংসাত্মক এক বিষয়। এর সঙ্গে আছে আর্থিক খাতের অবনমন। এই খাতে কাজ করা অল্প কিছু মানুষ বিপুলভাবে লাভবান হচ্ছেন, কিন্তু বাকিদের কাজ হচ্ছে, তাঁদের সফলতা নিশ্চিত করা। এরপর যখন তাঁদের লোভের কারণে পুরো ব্যবস্থা কলুষিত হবে, তখন তার জের টানতে হবে সেই সাধারণ খেটে খাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠদেরই। অর্থাৎ আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে মানুষের মধ্যে বৈষম্য শুধু বাড়ছেই, যেখানে বিপুল মানুষের শুধু যাপিত জীবনের মান নয়, জীবিকা অর্জনের সক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে তাঁরা যে নতুন সামাজিক চুক্তির সন্ধান করছেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; ট্রাম্প ও ব্রেক্সিট তাদের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছে।

ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বৈশ্বিক বিস্মৃতির আরও একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল হল, এই অসমতার রূঢ় রূপ একদম খোলাসা হয়ে গেছে। অতীতে   ব্যাপারটা এমন খোলাসা  ছিল না। আমার মনে হয়, প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ করা ইতিবাচক অভিজ্ঞতা, যা আমাদের স্বাধীনতা দিতে পারে। এটা ছাড়া আমি তো এতদিন ধরে কাজই করতে পারতাম না।

 এতে হয়েছে কী, গরিব মানুষের হাতে ফোন থাকলে সে ধনী মানুষের জীবনযাপনকে  দেখতে পারছে। সাহারা  কিংবা আফ্রিকা অঞ্চলে যত মানুষ ফোন ব্যবহার করে, তত মানুষ সুপেয় পানি পায় না। মানে  এই অসমতা থেকে বাঁচার উপায় নেই।

এর ফলাফল কী হবে, তা সাদা চোখে দেখা যায়—গ্রামের গরিব মানুষের শহরে ভিড় করে, বস্তিতে গাদাগাদি  করে থাকা এমন সব দৃৃশ্য দেকছি আমরা। সেইসব আশাহীন মানুষেরা গ্রাম থেকে  আশার ভেলায় ভর করে শহরে আসে। এরপর অনেকে উন্নততর জীবনের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমায় এবং  যেখানে যায়, সেখানে মানুষের সহিষ্ণুতা কমে যায় আর রাজনীতিতে জনপ্রিয় ধারা প্রধান হয়ে ওঠে!

এই অবস্থায় আমাদের ঐক্য জরুরী। একত্রে  কাজ করতে হবে এবং এর  প্রয়োজনীয়তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখথন  বেড়েছে। আমাদের কাছে এমন প্রযুক্তি আছে, যা দিয়ে আমরা পৃথিবী ধ্বংস করে দিকে পারি, কিন্তু সেই ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানোর প্রযুক্তি আমরা নির্মাণ করতে পারিনি আজও। সম্ভবত আগামী কয়েক দশকে আমরা তারকা জগতে  মানববসতি স্থাপন করতে পারব, কিন্তু মনে রাখতে হবে এখন আমাদের হাতে একটিই পৃথিবী। আমাদের একত্রে কাজ করে একে রক্ষা করতে হবে।

এর জন্য জাতিতে জাতিগত যে বৈরিতা, তাদের মধ্যে যে বিভেদের প্রাচীর ছিল, তা ভেঙে ফেলতে হবে। আমাদের যদি সেটা করতে হয়, তাহলে আমাদের বিশ্বনেতাদের  স্বীকার করতে হবে, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা নানাক্ষেত্রে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হচ্ছেনই। তাঁদের কর্মকাণ্ড অন্য অনেক মানুষকেও ব্যর্থ করেছে। আমাদের সম্পদ ক্রমাগত অল্প কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে, ফলে সেটা কীভাবে আরও বেশি করে ভাগাভাগি করা যায়, তা আমাদের উদারচিত্তে  শিখতে হবে।

ব্যাপারটা হল খুব সহজ। কারণ পৃথিবী থেকে চাকরি-বাকরি হারিয়ে যাচ্ছে না বরং শিল্পখাত হারিয়ে যাচ্ছে। তাই মানুষকে নতুন পৃথিবীর জন্য উপযুক্ত করতে হলে এরসঙ্গে তাদের আর্থিকভাবে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে  হবে। সমাজ ও অর্থনীতি যদি অভিবাসীদের এই স্রোত সামলাতে না পারে, তাহলে আমাদের বৈশ্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। সেটা করা গেলেই কেবল তারা ঘর ছেড়ে যাবে না, নিজ দেশেই কাজ পাবে এবং তা করে সন্তুষ্টও থাকবে।

ইচ্ছে  করলেই আমরা  এটা করতে পারি। আমি খুবই আশাবাদী । কিন্তু তার জন্য লন্ডন থেকে হার্ভার্ড ও ক্যামব্রিজ থেকে হলিউড পর্যন্ত—সব অভিজাত শে্অরণিকে অতীত থেকে শিক্ষা নিতে বলছি। আর  সবার আগে   তাঁদের সংযম শিখতে হবে, নম্র হতে হবে যা এখন এই ভয়ানক  অবস্থা  থেকে উত্তরনের  জন্য জরুরী।