আয়না২৪ ডেস্ক
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার পর কেউ কেউ দেশের জণগণের কথা ভাবে আবার কেউ কেউ ভাবে কেবল্নই নিজের কথা। এরকম নিজের কথা ভাবা কয়েকজন সম্পদশালী রাষ্ট্রপ্রধান সম্পর্কে জানুন এবং জানুন তাঁদের অর্থ-বিত্তের পরিধি সম্পর্কে।
সৌদি রাজবংশ (১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার)
সৌদি আরবের বাদশা আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ ২০১৫ সালে যখন মারা যান, তখন তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৭ বিলিয়ন ডলার। সৌদি রাজবংশের আরেকজন সদস্য হচ্ছেন আল ওয়ালিদ বিন তালাল। ২০১৫ সাল নাগাদ তালালের সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৮ বিলিয়ন ডলার। এক বছর আগে এই সম্পদের পরিমাণ ছিল ২০ বিলিয়ন ডলার। ফোর্বস ম্যাগাজিনের সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তির তালিকায় তার নাম আছে। তিনি বিশ্বের ৩৪ তম ধনী। সৌদি রাজবংশের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে এই পরিবারের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এত পরিমাণ সম্পদ নিয়ে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী পরিবার। উল্লেখ্য সৌদির মোট সম্পদের পরিমাণ (GDP) ১.৯ ট্রিলিয়ন।
তাদের এত পরিমাণ টাকার উৎস অবশ্যই তেল। তেল রপ্তানি থেকে বড় একটা লভ্যাংশ রেখে দেয় সৌদি রাজবংশ। শুধুমাত্র ২০১৪ সালেই তেল রপ্তানি থেকে সৌদির আয় হয় ২৬৮ বিলিয়ন ডলার।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি (২০০ বিলিয়ন ডলার)
২০১১ সালে গাদ্দাফির যখন পতন হয়, তখন তার ও তার পরিবারের সকল সম্পদ জব্দ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র জব্দ করে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। এছাড়া কানাডা ২.৪ বিলিয়ন ডলার, অস্ট্রিয়া ১.৭ বিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্য ১ বিলিয়ন ডলার জব্দ করে। এই খবর যখন প্রকাশ হয়, তখন অনেকেই অবাক হয় এত অর্থের মালিক তিনি হলেন কীভাবে? এরপরে দক্ষিণ আফ্রিকায় তার আরো সম্পদের খবর বের হয়। সেখানে তার বিনিয়োগকৃত যে পরিমাণ সম্পদ আছে, পরিমাণের দিক থেকে সেগুলোর ধারেকাছেও যেতে পারবে না জব্দ করা অর্থগুলো। আফ্রিকাতেই আছে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার। এতসব সম্পদ মিলিয়ে সমস্ত পৃথিবীতে এককভাবে গাদ্দাফিই সবচেয়ে বেশি ধনী।
আয়াতুল্লাহ খোমেনি (৯৫ বিলিয়ন ডলার)
ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনি একদমই সাধারণ জীবন-যাপন করেন। পদের দিক থেকে প্রেসিডেন্ট থেকে নীচে অবস্থান করলেও প্রভাবের দিক থেকে ইরানে তিনিই সবার উপরে। সময়ে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিষোদগার করেন। বাগান করেন, কবিতা পাঠ করেন, রুচিশীল মানুষ। তার সম্পদ সম্পর্কে খুব বেশি উচ্চ ধারণা ছিল না মানুষের। কিন্তু পরবর্তীতে রয়টারের অনুসন্ধোনে বেরিয়ে আসে খোমেনি প্রায় ৯৫ বিলিয়ন ডলারের মালিক। রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, কর্পোরেট ইনভেস্টমেন্ট, চ্যারিটি ফান্ড সহ অন্যান্য উৎস থেকে আসে এই অর্থ।
হোসনি মুবারক (৭০ বিলিয়ন ডলার)
মিশরের সামরিক নেতা হোসনি মুবারক ১৯৮১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর রাষ্ট্রপতি পদে বহাল ছিলেন। তিনিই মিশরের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসক। ১৯৭২ আল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিমান বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ১৯৭৫ সালে উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালে মূল রাষ্ট্রপতির পদে তিনি বহাল হন।
অনেকদিন ব্যাপী ক্ষমতায় থাকার ফলেই হয়তো বিশাল সম্পদ তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। বলা হয়ে থাকে মৃত্যুর সময় তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৭০ বিলিয়ন ডলার। সামরিক চুক্তি, ঘুষ, বৈধ ব্যবসা সহ আরো অন্যান্য উৎস থেকে এসেছে এই অর্থ। ওয়াশিংটন পোস্টের এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে তার পরিবারের মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৭০০ বিলিয়ন ডলার।
আলী আবদুল্লাহ সালেহ (৩০ বিলিয়ন থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার)
ইয়েমেনের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান তিনি। টানা ৩৩ বছর ছিলেন ক্ষমতায়। ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় বেরিয়ে আসে আলী আবদুল্লাহ প্রায় ৩০ বিলিয়ন থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলারের মালিক ছিলেন। প্রচুর ক্যাশ টাকা, সোনা, সম্পত্তি ও অন্যান্য পণ্য ছিল তার অধীনে। একসময় ইয়েমেনে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান করা হয়। আন্দোলনের মুখে একসময় তাকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়।
সুহার্তো (৩৫ বিলিয়ন ডলার)
ইন্দোনেশিয়ার সামরিক নেতা। ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক যিনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে তার পূর্বসূরি সুকর্নের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণের পরে টানা ৩১ বছর ধরে ইন্দোনেশিয়া শাসন করেন। তার শাসনামলে দেশ কিছু কিছু দিক থেকে উন্নতি লাভ করে, আবার কিছু কিছু দিকে অবনতি হয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রচুর সম্পদ আত্মসাৎ করেন তিনি। ধারণা করা হয় সুহার্তোর জমানো সম্পদের পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুসারে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিবাজ নেতা সুহার্তো।
বেন আলী (২২ বিলিয়ন ডলার)
তিউনিসিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদিন বেন আলী, পরবর্তীতে ক্ষমতাচ্যুত হন। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রচুর সম্পদ কামিয়েছিলেন। স্ত্রীকে দিয়ে ৩৭ মিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ পাচার করে নিতে চেয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ১৭ বিলিয়ন পাউন্ড (২২ বিলিয়ন ডলার)। দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে এই তথ্য। ক্ষমতাচ্যুতির পর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার সকল সম্পদ জব্দ করে ফেলে।
হাসানাল বলকিয়াহ (২০ বিলিয়ন ডলার)
ব্রুনাইয়ের বর্তমান সুলতান। ব্রুনাই দেশ হিসেবে অনেক ছোট, কিন্তু তেলে অনেক সমৃদ্ধ। সম্পদশালী এই শাসক অপব্যয় ও বিলাসিতার জন্য বিখ্যাত। একটি উদাহরণ দেই- তার প্রায় ৬০০ রোলস রয়েস কার আছে। এসব কার ব্যবহার হয় না। অব্যবহৃত অবস্থায় পার্কিংয়ে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ প্রাসাদ ‘ইস্তানা নুরুল ইমাম’-এ বসবাস করেন তিনি। এই প্রাসাদের ক্ষেত্রফল ২ মিলিয়ন বর্গফুটেরও বেশি। ভেতরে আছে ১ হাজার ৭৮৮টি রুম, ২৫৭টি বাথরুম, ৫ হাজার অতিথির ভোজের জন্য বিশাল একটি হলরুম, দেড় হাজার মানুষের নামাজ আদায়ের জন্য একটি মসজিদ, ১১০টি গ্যারেজ, ৫টি সুইমিং পুল, তার ঘোড়ার শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ ইত্যাদি। উল্লেখ্য ব্রুনাইয়ের অনেক মানুষ দারিদ্রতায় ভোগে।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকা অনুসারে হাসানাল বলকিয়াহ-এর মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। ব্রুনাইয়ের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে এসেছে এই সম্পদ।
ফের্দিনান্দ মার্কোস (১৫ বিলিয়ন ডলার)
ফিলিপাইনের সাবেক রাষ্ট্রপতি। ১৯৪৯ সালে সিনেটের প্রতিনিধি সভার সদস্য, ১৯৫৯ সালে সিনেটর, ১৯৬৩ সালে সিনেট সভাপতি এবং ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট। অনেকগুলো মার্কিন প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছিল ফিলিপাইনে। মার্কোসের পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো । মার্কিন মদদপুষ্ট এই নেতার পরিবার কর্তৃক বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়।
তার শাসনামলে ফিলিপাইনের রাষ্ট্রীয় ঋণ ২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে। দেশ থেকে কত পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তার ঠিক ঠিক হিসাব নেই। ধারণা করা হয় তার আত্মসাৎকৃত সম্পদের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার। ১৯৮৬ সালে তার ক্ষমতা শেষ হয়ে যায় এবং তাকে পরিবারসহ হাওয়াইতে চলে যেতে হয়। যাবার সময় দুটি ট্রান্সপোর্ট প্লেন ভর্তি করে তার সম্পদ নেয়া হয়। এতে ছিল ৬৭ র্যাক বিলাসবহুল দামী পোশাক, ৭০ জোড়া রত্নের কাফলিঙ্ক, ২৪টি গোল্ড ব্রিক।
কিম জং-ইল (৫ বিলিয়ন ডলার)
উত্তর কোরিয়ার প্রাক্তন শাসক, বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান কিম জং-উনের পিতা। উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক দল ‘ওয়াকার্স পার্টি’র মহাসচিব ছিলেন। কিছুটা আত্মপ্রেমী (নার্সিসিস্ট) ছিলেন। তার নিজের অবয়বের প্রায় ৩৪ হাজার মূর্তি স্থাপন করে সারা দেশে। ধারনা করা হয় তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার।
সম্পদশালী আরো কয়েক রাষ্ট্রপ্রধান
মবুতু সেসি সিকু (৫ বিলিয়ন ডলার)- কঙ্গোর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট
সাপারমুরাত নিয়াজভ (৩ বিলিয়ন ডলার)- তুর্কমেনিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট
সানি আবাচা (৩ বিলিয়ন ডলার)- নাইজেরিয়ার প্রাক্তন সেনাপ্রধান। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ডি ফ্যাক্টো প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সাদ্দাম হোসাইন (২ বিলিয়ন ডলার)- ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট
বাশার আল আসাদ (১.৫ বিলিয়ন ডলার)- সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট
ইসলাম কারিমভ (১ বিলিয়ন ডলার)- উজবেকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। ২০১৬ সালে তার মৃত্যু ঘটে।
টিওডরো মাবাসোগো (৬০০ মিলিয়ন ডলার)- ইকুয়েটগিনির প্রেসিডেন্ট
আলবার্তো ফুজিমোরি (৬০০ মিলিয়ন ডলার)- পেরুর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট
ডেনিস সাসো গুয়েসো (৩৮০ মিলিয়ন ডলার)- কঙ্গোর বর্তমান প্রেসিডেন্ট
রবার্ট মুগাবে (১০ মিলিয়ন ডলার)
জিম্বাবুয়ের বর্তমান রাষ্ট্রপতি। শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। ১৯৮০ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। ১৯৮৭ সাল থেকে জিম্বাবুয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এই পদে এখন পর্যন্ত বহাল আছেন। ধারণা করা হয় তার মোট সম্পদের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার।
এই তালিকার বাইরেও অনেক রাষ্ট্রপ্রধান আছে যারা অনেক সম্পদশালী। তবে তাদের সম্পদের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে কত তার বিশ্বস্ত কোনো সূত্র পাওয়া যায় না। তাই তাদেরকে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। যেমন বলা হয়ে থাকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৭৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু কারণবশত পুতিনকে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে।