আয়না২৪ ডেস্ক
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ১৩টি শর্ত দিয়েছে সৌদি আরবসহ চারটি আরব দেশ। এই সব শর্তের অন্যতম হল, দেশের জনপ্রিয় খবরের চ্যানেল ‘আল জাজিরা’র সম্প্রচার বন্ধ করতে হবে। শর্তে আরা রয়েছে, উপসাগরীয় রাজনীতিতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সব ব্যাপারে ইরানকে শিখণ্ডী হিসেবে তুলে ধরা যাবে না। আগামী ১০ দিনের মধ্যে যাবতীয় নির্দেশ মানতে পারলে তবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে এসব দেশ।
সন্ত্রাসে প্রত্যক্ষভাবে মদত দেওয়ার অভিযোগে চলতি মাসের শুরুতে উপসাগরীয় রাজনীতিতে কাতারকে একঘরে করে সৌদি আরব, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরা্ইন। দোহার সঙ্গে সবরকম কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এই চার দেশ।
কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার মুখে পড়ে বৃহস্পতিবার শর্তসাপেক্ষে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে রাজি হয়েছে চারটি দেশ। তবে এজন্য কাতারকে মোট ১৩টি শর্ত দিয়েছে তারা।
তাতে বলা হয়েছে, সৌদি আরব, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরা্ইন— এই চারটি দেশ থেকে আসা মানুষদের স্বাভাবিক নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না। আবার এখন যাঁরা কাতারে রয়েছেন, তাঁদের এই মুহূর্তেই বের করে দেওয়া যাবে না। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কাতার যাতে অনধিকার চর্চা না করতে পারে, সে জন্যই এমন নির্দেশ!
১৩ দফা শর্তে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মে অভিযুক্ত যে সব ব্যক্তি ওই চারটি দেশের অপরাধ তালিকায় রয়েছে, অবিলম্বে তাদের ফিরিয়ে দিতে বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, এমন কোনও চরমপন্থী সংগঠনকে অর্থ জোগান দেওয়া যাবে না। সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় অঞ্চলের বাকি দেশের যে সব বিদ্রোহী সংগঠনকে এতদিন আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
শুরু থেকেই সন্ত্রাসে সমর্থনের কথা অস্বীকার করে এসে এসেছে কাতার। তবে ‘হামাস’ সহ বেশকিছু চরমপন্থী সংগঠনকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে তারা। তাদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চললেই একমাত্র বিরোধের নিষ্পত্তি সম্ভব বলে দাবি তাদের।
কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলি তা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, শুধু চরমপন্থী সংগঠন নয়, ‘আল–কায়দা’ এবং আইএসের মতো পশ্চিম এশিয়ার জঙ্গি সংগঠনগুলির কাজকর্মেও পুরোপুরি সমর্থন রয়েছে দোহার। লেবাননের ‘হিজবুল্লা,’ সিরিয়ায় ‘আল–কায়দার শাখা সংগঠন যা এককালে ‘নুসরা ফ্রন্ট’ বলে পরিচিত ছিল, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ ওঠাবসা রয়েছে কাতার প্রশাসনের। নিষেধাজ্ঞা থেকে রেহাই পেতে হলে ওই সংগঠনগুলোর সঙ্গে সমস্ত সংযোগ ছিন্ন করতে হবে।
শিয়া নেতৃত্বাধীন ইরানের সঙ্গে কাতারের যোগসূত্র শুরু থেকেই ভালভাবে নেয়নি সুন্নি মতালম্বী আরব দেশগুলি। কাতারকে একঘরে করার পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল এটা। উপসাগরীয় রাজনীতিতে টিকে থাকতে গেলে ইরানের সঙ্গে দুরত্ব বাড়াতে হবে বলে শর্ত দিয়েছে তারা। উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের প্রভাব ঠেকানোর কাজ করে উপসাগরীয় সমন্বয় পরিষদ (গাল্ফ কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল)। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ইরানের সঙ্গে দুরত্ব বাড়িয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে ওই সংগঠনে যোগ দিতে বলা হয়েছে কাতারকে। এছাড়া ইরানের সঙ্গে সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কাতারে মোতায়েন ইরানের ‘এলিট রেভলিউশনারি গার্ড’ বাহিনীকে অবিলম্বে দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই, শুধুমাত্র সেই ধরনের বাণিজ্যিক লেনদেন চালানো যাবে। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির আওতায় ইরানের উপর থেকে পরমাণু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তবে বাকিগুলি আগের মতোই বহাল রয়েছে।
ইরানের দখলে সমুদ্র উপকূলে বিশাল প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। সেখান থেকে কাতারকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করে তারা। আরব দেশগুলির নির্দেশ মানতে গেলে তা বন্ধ হয়ে যাবে। কাতারে তুরস্ক বাহিনীর একটি সেনাঘাঁটি রয়েছে। সেটিও বন্ধ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
উপসাগরীয় রাজনীতির সঙ্গে মতামত খাপ খায় না বলে দীর্ঘদিন ধরেই আরব দেশগুলির কুনজরে ছিল কাতারের জনপ্রিয় খবরের চ্যানেল ‘আল–জাজিরা।’ কারণ পশ্চিম এশিয়ার সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিকে নিয়ে তাদের অবস্থান বরাবরই একটু আলাদা। সুযোগ পেয়ে তাই ‘আল–জাজিরা’র উপরে খাঁড়া নামিয়েছে তারা। নিষেধাজ্ঞা থেকে রেহাই পেতে হলে ‘আল–জাজিরা’র সম্প্রচার বন্ধ করতে হবে বলেও শর্ত দিয়েছে আরব দেশগুলি। এমনকী ‘আল–জাজিরা’র ইংরেজি চ্যানেলটির সম্প্রচারও বন্ধ করতে বলা হয়েছে। দু’টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘আরবি ২১,’ ‘মিডল ইস্ট আই’–কেও বন্ধ করতে হবে।
আগামী ১০ দিনের মধ্যে শর্তপূরণ করতে পারলে কাতারের ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। তবে আগামী এক বছর প্রতি একমাস অন্তর একটি করে অডিট করা হবে। দ্বিতীয় বছরে অডিট হবে প্রতি তিনমাস অন্তর।
আগমী ১০ বছর প্রতি বছরের বার্ষিক নিরীক্ষণ করা হবে। শর্তপূরণে রাজি কি না সে ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করেনি কাতার প্রশাসন। তবে নিষেধাজ্ঞা না উঠলে আরব দেশগুলোর সঙ্গে কোনও আপসে আসবেন না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন কাতারের বিদেশমন্ত্রী শেখ মহম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি।