আয়না ২৪ ডেস্ক
মার্কিন মুলুকে এখন ঘোর অনিশ্চয়তায় কাটছে বিদেশিদের একাংশের। ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার বন্ধনীতে সীমাবদ্ধ দেশগুলিই নয়, কী হয় কী হয় ভাব এখন অন্য দেশের নাগরিকদের মধ্যেও। কারণটা বোঝা খুব শক্ত নয়। তাঁদের মনে আশঙ্কা, এই ভিসা সংক্রান্ত নির্দেশেই কি ট্রাম্প থামবেন? নাকি এটা সবে শুরু!
এই ফিলাডেলফিয়ার কথাই ধরা যাক। পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (ইউপেন) কর্তৃপক্ষ এখানকার আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, সহায়ক-কর্মীদের (আমেরিকান নন) উদ্দেশে একটা বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। একে সতর্কবার্তাই বলা ভাল। ওই বিজ্ঞপ্তিতে সাতটি দেশের ছাত্রছাত্রীদের তো বটেই, অন্য যাঁরা কখনও ওই সমস্ত দেশে গিয়েছেন বা ওই দেশগুলির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রয়েছে, তাঁদেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিদেশে যাওয়ার আগে ভাল করে ভেবে দেখতে। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমেরিকার প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে পরিচিত ইউপেন সব দেশের নাগরিকদের সমমর্যাদা দিতেই অভ্যস্ত। কিন্তু অভিবাসন কানুন যদি এ ভাবে বদলায় তা হলে কী হবে বলা মুশকিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট অ্যামি গাটম্যান স্পষ্টতই ট্রাম্পের নির্দেশকে মার্কিন মূল্যবোধের উপর আঘাত বলে বর্ণনা করেছেন। নাৎসি জমানায় এক সময় দেশ ছেড়েছিলেন অ্যামির ঠাকুর্দা। তাঁর পরিবারের জামাইও একজন অভিবাসী। জানিয়েছেন তিনি। আমেরিকার অন্য অনেক পরিবারের মতো তাঁরাও এই দেশটাকে ভালবেসেছেন এবং এখানকার বিশাল কর্মযজ্ঞে সামিল হয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, কাজের পরিবেশ নষ্ট করছেন ট্রাম্প।
এতে বোঝা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী মনোভাবটা। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয়, তাঁরা কতটা সন্দিহান ট্রাম্পের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। অনিশ্চয়তাটা এতটাই যে, নির্দেশে এ-ও বলা হয়েছে, যদি কেউ অন্য দেশে যান এবং ফেরার সময় কোনও মার্কিন বিমানবন্দরে আটকানো হয়, তবে অবশ্যই পেনসিলভ্যানিয়া পুলিশকে তা জানান।
গতিক সুবিধের নয় বুঝে পরিচিত এক বাঙালি দম্পতি, শাশ্বতী সেন এবং সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় (নাম পরিবর্তিত), বুধবার তাঁদের যাত্রা বাতিল করলেন। যাদবপুরের বাসিন্দা ওই দম্পতির আশঙ্কা, দেশ থেকে ফেরার পথে যদি আর এদেশে ঢোকার সুযোগ না পান? এমনকী আমেরিকার বাইরে যাওয়ার টিকিট কেটেও তা বাতিল করবেন কি না ভাবছেন এক ফরাসী-জার্মান দম্পতি।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফেও এরকম বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এক বাঙালি ছাত্রী। এ দেশের বুদ্ধিজীবী মহল ট্রাম্পের এই সব পদক্ষেপ নিয়ে বিব্রত এবং বিরক্ত। কিন্তু তাঁদের আশঙ্কা, তাঁরাই সংখ্যালঘু। বিপদটা সেখানেই।
সে দিন বলেছিলেন ট্রাম্পকে নিয়ে। সঁ গোবেঁ (ফরাসী) বুলেটপ্রুফ কাচে মোড়া ইকেয়া (সুইডিশ) পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে, ফোর-কে সোনি (জাপানি) ভিডিও ক্যামেরার জেনহায়জা (জার্মান) ডলবি মাইক্রোফোনে ট্রাম্প এখন দেশাত্মবোধক বাণী আওড়াচ্ছেন। আমেরিকান জিনিস কিনুন, আমেরিকানদের কাজ দিন আর অভিবাসীদের আটকান। তাঁর হাতে রোলেক্স (সুইস) ঘড়ি, পাশে স্লোভেনীয় স্ত্রী। ঠাট্টা দূরে সরিয়ে রাখলেও, আমেরিকার অবস্থাটা কম বেশি এমনই।ট্রাম্প আমেরিকাকে আবার ‘মহান’ করার ডাক দিয়েছিলেন। সেই ডাকেই সাড়া দিয়ে তাঁর হাতে আমেরিকা সঁপেছে দেশবাসী। ক্ষমতায় এসে দেশকে ‘মহান’ বানাবার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছেন এক সপ্তাহেই তা মালুম হয়েছে সারা বিশ্বের। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে আমেরিকাবাসীর নিরাপত্তাকেই বেছে নিয়েছেন তিনি।
কিন্তু কোন আমেরিকা? কার আমেরিকা? কারাই বা তাকে মহান করেছিল? আবার মহান করতে হবে কেন? কারাই বা তা করবে? বলতে কী, ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে এক সপ্তাহ বসতে না বসতেই আমেরিকার সত্তায় যে ঝাঁকুনিটা দিয়েছেন তার জেরে অতি বড় আমেরিকানকেও এই প্রশ্নগুলো ভাবাচ্ছে। আমেরিকান কারা? এটা আমেরিকা এখন নতুন করে ভাবতে বসেছে।
আমেরিকান-ইন্ডিয়ান ছাড়া কেউই এদেশের ভূমিপুত্র নন। ওবামার পরিবার যেমন এসেছিল কেনিয়া থেকে, ট্রাম্পের ঠাকুর্দা এসেছিলেন জার্মানি থেকে। সেভাবে দেখতে গেলে দেশটাই ‘বিদেশি’দের। দেশটাকে ‘মহান’ করেছিল তারাই। এদেশে এক দিন যাঁরা শরণার্থী হয়ে এসেছেন, তাঁরাই আজ এখানকার অধিবাসী। ভবিষ্যতেও এই প্রক্রিয়া চলবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ আজও উন্নততর জীবনের খোঁজে আমেরিকামুখী। বিভিন্ন দেশের মানুষ এখানে তাঁদের বুদ্ধি এবং শ্রম দিয়ে দেশটাকে গড়ে তুলেছেন। যে প্রশ্ন তুলে ট্রাম্প হঠাৎ সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যহত করতে চাইছেন তা কি শুধুই নিরাপত্তার খাতিরে?
সম্ভবত না। তাঁর পর পর পদক্ষেপগুলি একটু খেয়াল করলেই স্পষ্ট হবে, এগুলো তাঁর প্রাক-নির্বাচন প্রতিশ্রুতি। মেক্সিকোর দেওয়াল হোক বা সাত দেশের নাগরিকদের উপর আমেরিকায় প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা। যাঁদের অস্মিতা উসকে দিয়ে আড়াআড়ি বিভাজনের রাস্তায় হেঁটেছিলেন ট্রাম্প, এবং সুফল পেয়েছিলেন এবার তাঁদের কাছে কথা রাখার পালা। তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এখানে ছাপিয়ে গিয়েছেন ব্যক্তি ট্রাম্প। কী ভাবে? এর উত্তর রয়েছে তাঁর ‘এগজিকিউটিভ অর্ডার’গুলোর মধ্যেই। এই নির্দেশগুলোর অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার জন্য তিনি খুব বেশি সময় নেননি। রিপাবলিকানরাই কি জানত তাঁর এই পরিকল্পনার কথা? আসলে সেই অবকাশই তিনি রাখেননি।
দেখেশুনে অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করার ব্যাপারে তিনি যে বদ্ধপরিকর, তার প্রমাণ দিতেই এখন উঠেপড়ে লেগেছেন ট্রাম্প। যাঁদের সমর্থনে তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তাঁদের অন্তত এটুকু বোঝাতে চান- তাঁর সদিচ্ছার অভাব নেই। তবে এই ‘অতি তৎপরতা’ সাময়িক বলেই অনেকের ধারণা। কারণ যেভাবে এগোচ্ছেন ট্রাম্প, তাতে বিস্তর আইনি জটিলতার মুখোমুখি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। ইতিমধ্যেই তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সংবিধান বিরোধী কাজকর্মের অভিযোগ উঠেছে।
তবে আপাতত যে একটা হইচই ফেলে দিয়েছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।