আয়না ২৪ ডেস্ক
আসন্ন এক মাসের মধ্যেই ইরানে নির্মীয়মাণ চাবাহার বন্দর বাণিজ্যের জন্য খুলে যাবে বলে বলে সোমবার আশাপ্রকাশ করেছেন আফগান রাষ্ট্রদূত মহম্মদ আমান আমিন৷ এই বন্দরটি খুলে গেলে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন সম্ভব হবে৷ পাকিস্তানের অভ্যন্তরের রাস্তা এড়িয়ে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার বাজারে পৌঁছতে পারবে ভারত। এতে ব্যবসা লেনদেনের সময়, অর্থ দুই’ই অনেকটা বাঁচবে। ভারতের জন্য এই ‘ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রেড করিডর’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ আমিন বলেছেন, “আশা করি আর এক মাসের মধ্যেই চাবাহার বন্দর খুলে যাবে ও ভারত-আফগানিস্তানের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে৷”
চিনের আর্থিক সাহায্যে পাকিস্তানে নির্মীয়মাণ গদর বন্দরের পাল্টা এই চাবাহার বন্দর গড়ছে ভারত৷ আরব সাগরের তীরে বালুচিস্তানে নির্মীয়মাণ গদর বন্দরের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে৷ পাক-চিন সড়ক যোগাযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি, চিনের কাশগড় থেকে সড়ক মারফত বিপুল চিনা পণ্য, সামরিক সরঞ্জাম, সেনাবাহিনী, সাঁজোয়া গাড়ি অতি দ্রুত বালুচিস্তানের মধ্য দিয়ে গদর বন্দরে নিয়ে আসার কাজ সহজ ও দ্রুততর হবে চিনের পক্ষে৷ বাণিজ্য বাড়লে পাকিস্তানের জাতীয় আয়ও বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে৷ একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক কৌশলগত অবস্থান পোক্ত হবে চিনের৷ কারণ গদর বন্দরের মধ্যে দিয়ে আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে খবরদারি করতে পারবে চিন৷ কিন্তু পাকিস্তান ও চিনের রণকৌশলগত এই একাধিপত্যে জল ঢেলে দিয়েছে ভারতের এই জোরাল পদক্ষেপ৷ নয়াদিল্লির এই পদক্ষেপ আগে থেকে আঁচ করতে পারলেও প্রথমে তেমন আমল দেয়নি বেজিং ও ইসলামাবাদ৷ কিন্তু ভারতের এই পদক্ষেপ এখন পাকিস্তানের টেনশন ও মাথাব্যথার কারণ হয়ে গিয়েছে৷ কারণ, গদর বন্দরের খুব কাছে, মাত্র ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ইরানের চাবাহারে ওই উন্নত বন্দরটির কাজ এখন শেষের মুখে৷
২০১৬ সাল থেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চাবাহারে কাজ করছেন কেন্দ্রীয় জাহাজ মন্ত্রক-সহ ভারতের বেশ কিছু নামী বেসরকারি সংস্থার অজস্র কর্মী৷ ভারত-ইরান যৌথ সহযোগিতায় তৈরি হতে চলা চাবাহার হতে চলেছে গদর বন্দরের উপযুক্ত জবাব৷ কারণ, চাবাহারের মধ্যে দিয়ে ভারত আর্থিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক দিক দিয়ে আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করবে৷ একইসঙ্গে পাশেই বালুচিস্তানে পাকিস্তান বিরোধী জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিংসায় মদত দেবে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’৷ এমনটাই মনে করছে ইসলামাবাদ৷ পাকিস্তান মনে করে, চাবাহার বন্দর চালু হলেই ভারত গদর বন্দরের প্রভাব খর্ব করতে উঠে পড়ে লাগবে৷ গদরের সঙ্গে চিনের কাশগড় অবধি সংযোগকারী আন্তর্জাতিক হাইওয়ে তথা সিল্ক রুট ধবংস করতে বিরতিহীনভাবে নাশকতা চালাবে ভারতীয় চররা৷ পাকিস্তান মনে করে, আরব সাগরে বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রাধান্য বজায় রাখতে ইরানের চাবাহারকে বেস করে চিনের নৌবাহিনী, পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যেতে চলেছে ভারতীয় নৌসেনা৷ কারণ আরব সাগর, ওমান উপসাগর, পারস্য উপসাগর ও ভারত মহাসাগরে যে কোনও মূল্যে আধিপত্য বজায় রাখতে চায় দিল্লি৷
এই একাধিপত্য হারালে মুম্বই, কান্দালা, ম্যাঙ্গালোর, কোচি-সহ পশ্চিম ভারতের ২০টি ছোট বড় বন্দর মারফত ভারতের পণ্য চলাচল ও পরিবহণ ব্যাপক মার খাবে৷ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কয়েক হাজার কোটি ডলারের রাজস্ব হারাবে ভারত৷ একইসঙ্গে আফগানিস্তানে ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব নষ্ট হবে৷ পাকিস্তানের আইএসআই ও চিনের গোপন সামরিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে তাজিকিস্তানে, আফগানিস্তানে ভারত যে গোপন সামরিক কৌশলগুলি নিচ্ছে তাও নষ্ট হয়ে যাবে৷ তাই চিন-পাক যুগলবন্দি রুখে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে ভারত চাবাহারকে রক্ষা করতে মরিয়া৷ এই উদ্যোগে সায় রয়েছে ইরানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ও প্রেসিডেন্ট রুহানির৷
ইরান জানিয়েছে, তাদের বিতর্কিত পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে গোটা দুনিয়া যখন এককাট্টা হয়েছিল এবং অবরোধ জারি করে ইরানের আর্থিক অবস্থা বেহাল করে দিয়েছিল তখন তাদের আদি অকৃত্রিম বন্ধু ভারত দুনিয়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাদের কাছে কয়েক কোটি ডলারের তেল কিনেছে৷ ভারত সস্তায় তেল ও পেট্রোপণ্য পেয়েছে৷ বিনিময়ে ইরান দু’বছর ধরে প্রচুর অর্থ আয় করেছে৷ তাদের অসামরিক পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে ভারত কোনওদিন অভিযোগ করেনি৷ উল্টে আমেরিকা, রাষ্ট্রসংঘ-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গে সম্মানজনক আলোচনায় ইরানের হয়ে মধ্যস্থতা করেছে ভারতই৷ শুধু তাই নয়, বিশ্বের একমাত্র শিয়া মুসলিম দেশ ইরানের সঙ্গে নয়াদিল্লির সুসম্পর্ক ৬০ বছরের৷ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পাকিস্তান হল পরমাণু শক্তিধর সুন্নি মুসলিমদের দেশ৷ পাকিস্তানের সুন্নি জঙ্গিদের সঙ্গে ইরানের বৈরিতা কয়েক দশকের৷ ইরানের চারদিকে রয়েছে তাদের চিরশত্রু আমেরিকার ঘাঁটি৷ ইরাক, কাতার, বাহরিন, কুয়েতে মার্কিন নৌ বহর মোতায়েন থেকে কড়া নজরদারি চালায় ইরানের উপর৷ তার উপর মার্কিন বন্ধু সৌদি আরব হল কট্টর সুন্নি মতাবলম্বী দেশ৷
হাজার হাজার বছরের পারস্য সভ্যতার উত্তরাধিকারী ইরান মহাকাশ গবেষণা ও পরমাণু কর্মসূচিতে উন্নত৷ কিন্তু তাদের যতটা শত্রু ইজরায়েল ও ইহুদিরা তার চেয়েও বড় শত্রু সৌদি আরব, আমেরিকা এবং ইসলামিক স্টেট৷ আল কায়দা-সহ কুখ্যাত সুন্নি জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গেও দুই দশকের দুশমনি রয়েছে ইরানের৷ কারণ ইরান শিয়া মুসলিম দেশ৷ তাদের কোনও বিশ্বস্ত বন্ধু নেই৷ চারদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত তেহরানের ভরসা তাই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারত৷ ইরানের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে পরমাণু শক্তিধর সুন্নি পাকিস্তান৷ পাশের ভূখণ্ড ইরাক, কুয়েত থেকে নজর রাখছে আমেরিকা৷
ইরান জানে কয়েক কোটি শিয়া মুসলিম ভারতে হাজার বছর ধরে বসবাস করছেন নিরাপদে ও শান্তিপূর্ণভাবে৷ তাই আন্তর্জাতিক স্তরে ভারত ও রাশিয়া ছাড়া ইরানের কোনও বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু নেই৷ এই অবস্থায় ইরান জানিয়েছে, চাবাহার বন্দরকে ভারত কী কী কাজে ব্যবহার করবে তা নিয়ে তাদের কোনও আগ্রহ নেই৷ কারণ ইরান নিশ্চিত, তাদের বিপদের দিনে সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারত এই বন্দরকে ইরানের কোনও স্বার্থবিরোধী কাজে ব্যবহার করবে না৷ তাছাড়া ইরানের জাতীয় আয়ও বাড়বে এই বন্দর থেকে৷ সমৃদ্ধ হবে ইরানের পিছিয়ে পড়া অর্থনীতি৷উপগ্রহ উৎক্ষেপণ-সহ মহাকাশ গবেষণায় ইরানকে নিজের খরচে সাহায্য করবে বলে জানিয়েছে ভারত৷ এ নিয়ে ইরানের যা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে তা পূরণ করার ব্যবস্থা করবে ভারত৷ বিনিময়ে ভারত চাবাহার বন্দরকে নিজের মতো ব্যবহার করতে চায়৷
পাকিস্তানের শঙ্কা, ভারত চাবাহার বন্দর দিয়ে তাদের বাণিজ্যিক জাহাজ ও যুদ্ধজাহাজগুলি নিয়ে বালুচিস্তানের বিদ্রোহীদের হাতে সামরিক সরঞ্জাম, রসদ পৌঁছে দেবে৷ বিদ্রোহীদের হাত শক্ত হলে বালুচিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাবে পাকিস্তান৷ কাশ্মীর-সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি কাজকর্মে পাকিস্তানি মদত, রক্তক্ষয় ও ভারত বিরোধিতার যোগ্য জবাব এইভাবেই দিতে চায় দিল্লি৷ ইসলামাবাদ ভীত কারণ, চাবাহারে পণ্য ও সামরিক সরঞ্জাম খালাস করে ভারত তা সড়কপথে আফগানিস্তানের নিমরোজ প্রদেশ দিয়ে ঢুকতে পারবে৷ তা সহজেই ছড়িয়ে দেওয়া যাবে গোটা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বালুচিস্তানে৷ এই গোটা প্রক্রিয়াটি দেখভাল করবে ভারতের গুপ্তচর সংগঠন ‘র’৷ পাকিস্তানের দাবি, চাবাহারে এখনই শতাধিক র-কর্মী সক্রিয় রয়েছেন যারা গদর বন্দরের কাজকর্ম ও সিল্ক রুটের বারোটা বাজিয়ে দিতে চায়৷
এই অবস্থায় তালিবান জঙ্গিদের, আফগানিস্তানে সক্রিয় ইসলামিক স্টেট, হক্কানি নেটওয়ার্ককে মদত দিয়ে আফগানিস্তানে সন্ত্রাস ও রক্তপাত জিইয়ে রাখতে চাইছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী৷ তবে এরকম চলতে থাকলে পাকিস্তানকে নিরাপত্তা পরিষদের কাঠগড়ায় তুলবে আফগানিস্তান৷ যদিও, ইরানের সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট চাবাহার বন্দরে ভারতের র-এর গুপ্তচরদের থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, পাকিস্তান নিরাপত্তাহীনতা থেকেই এইসব ভুলভাল কথা বলছে৷ ইরান জানিয়েছে, চাবাহার কখনওই গদরের জবাব নয়৷ চাবাহার ইরান-ভারত যৌথ সহযোগিতার ফসল৷ গদরে চিন-পাকিস্তান কী করছে তা নিয়ে তেহরানের কোনও মাথাব্যথা নেই৷ ভারতও সরকারিভাবে জানিয়েছে, চাবাহার সঙ্গে পাকিস্তানের গদর বন্দরে কি হচ্ছে তার কোনও যোগ নেই৷ কিন্তু সাউথ ব্লকের মতে, বেজিংয়ের দাদাগিরি বন্ধ করতে, তাদের কপালে ভাঁজ ফেলতে ও ইসলামাবাদের রক্তচাপ বাড়াতে অনেকটাই সফল নয়াদিল্লি৷