আয়না২৪ আন্তর্জাতিক ডেস্ক
সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দখল থেকে আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নগরী আলেপ্পো। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের অনুগত সেনাদের তুমুল হামলার মুখে টিকতে না পেরে বিদ্রোহীরা সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে নগরীটির নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভিতাইল চুরকিন জানান, আলেপ্পোয় সামরিক অভিযান বন্ধ রাখা হয়েছে। পুরো শহরের দখল এখন প্রেসিডেন্ট আসাদের সেনাদের হাতে চলে এসেছে। আটকে থাকা সাধারণ নাগরিক ও বিদ্রোহীরা এখন নিরাপদে সরে যেতে পারবেন। এভাবেই আলেপ্পোয় প্রায় পাঁচ বছরের লাগাতার যুদ্ধের সমাপ্তি হল।
সমঝোতা অনুযায়ী, প্রথমে সাধারণ নাগরিকরা চলে যাবেন। তার পরে যেসব বিদ্রোহী এখনও রয়ে গেছেন তাঁদের চলে যেতে দেওয়া হবে। নাগরিক ও বিদ্রোহীদের হয় পশ্চিম আলেপ্পোয় বা ইদলিবে নিয়ে যাওয়া হবে। বিদ্রোহীদের পক্ষ থেকেও সমঝোতার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
আসাদের সেনাদের লাগাতার হামলায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় বিদ্রোহীদের। প্রায় ৯০ শতাংশ আলেপ্পো আসাদের বাহিনীর হাতে চলে আসে। আলেপ্পো শহরের পূর্ব দিকে কয়েকটি জায়গায় বিদ্রোহীরা লড়াই চালাচ্ছিল। শুরু হয়েছিল গণহত্যাও। অভিযোগ আছে, এ্ররইমধ্যে ৮২ জনকে দেখা মাত্র হত্যা করেছে আসাদের সৈন্যরা। আরও বড় গণহত্যার আশঙ্কা করছিলেন অনেকে। আশা করা হচ্ছে, এই সমঝোতার পর সেখানে রক্তপাত বন্ধ হবে। পাশাপাশি আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানো পশ্চিমা বিশ্বের মদদপুষ্ট শক্তিকে সিরিয়ার ক্ষমতায় আনার চেষ্টাও আপাতত শেষ হল। যে চেষ্টায় মদত দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।তাতে সায় ছিল ইউরোপের বড় শক্তিগুলোরও। এতে সাহায্য করেছিল সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতের মতো দেশ। এবং ওবামা নয়, বছরের শেষ হাসিটিও হাসতে চলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
আর পাঁচটা শহরের থেকে অনেকটাই আলাদা আলেপ্পো। ভূমধ্যসাগরের তীরে এ অঞ্চলের ইতিহাস শুরু হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব একবিংশ শতক থেকে। কালের ঝ়ড়-ঝাপটা সয়ে এত দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল আলেপ্পো। ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইট হিসেবে আলেপ্পো স্বীকৃত। ইতিহাস বলছে এক সময়ে সফল বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল আলেপ্পো। স্বাধীন সিরিয়ায় অন্যতম শিল্পকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আলেপ্পো।
আর আজ প্রায় ধ্বংসস্তুপ, শ্মশান হয়ে যাওয়া সেই শহরের ধুলোমলিন পথে বিজয়গর্বে এগিয়ে চলেছে আসাদের সেনা। কিন্তু এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল? ২০১১ থেকে সিরিয়া যখন প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে উত্তাল তখন শান্তই ছিল আলেপ্পো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়া সে ভাবে আসাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখা যায়নি। পরিস্থিতি আচমকাই পাল্টে যায় ২০১২-এর জুলাই মাসে। এত দিন ধরে যে ক্ষোভ ছিল ছড়ানো-ছেটানো তাই দানা বেঁধে বিদ্রোহের আকার নেই। বিদ্রোহীরা আলেপ্পো থেকে সিরিয়ার সেনা সরাতে আক্রমণের পথ নেয়। বেশ খানিকটা অঞ্চল থেকে সিরিয়ার সেনাকে সরিয়ে দিতে সক্ষমও হয় বিদ্রোহীরা। ধীরে ধীরে উত্তর সিরিয়া জুড়ে আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চরম আকার নেয়।
তার পরে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি। শহরের পশ্চিম দিকে বিদ্রোহীরা। অন্য দিকে আসাদের সেনা। কখনও আসাদের সেনা কিছুটা এগিয়ে আসে। কখনও বিদ্রোহীরা নতুন এলাকার দখল নেয়। আর এর মাঝে শহরটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হেরিটেজ সাইটগুলি পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। বিদ্রোহীদের ঠেকাতে আলেপ্পো জুড়ে ব্যারেল বোমা ফেলতে শুরু করে আসাদের বিমানসেনারা। কিন্তু সে বোমায় শুধু বিদ্রোহীরা মারা পড়েনি। সাধারণ মানুষও হতাহত হয়েছে অনেক। সঙ্গে শুরু হয় অবরোধ। খাদ্য ও ত্রাণ সামগ্রীর অভাবে আটকে পড়া সাধারণ নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
সিরিয়া যখন উত্তাল এবং আসাদের গদি যখন টলমল, তখন প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল পশ্চিমী বিশ্ব। সিরীয় সেনাদের গণহত্যা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতেও দ্বিধা ছিল। কারণ, এই সুন্নি বিদ্রোহীদের সঙ্গে মৌলবাদীদের যোগাযোগ ছিল। তবে পরে দ্বিধা কাটে। আলেপ্পোয় মৌলবাদের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন বিদ্রোহীরা এক সঙ্গে করে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ তৈরি হয়। আমেরিকাসহ পশ্চিমি বিশ্ব সমর্থন দেয় তাদের। অস্ত্র ও অর্থ জোগানও দেয় তারা। সৌদি আরবসহ সুন্নি দেশগুলিও সমর্থন করেছে। বিপদে-আপদে এই বিদ্রোহীদের পিছনে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে রাজনৈতিকভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। সিরিয়া সংক্রান্ত শান্তি আলোচনায় তাদের প্রতিনিধিরা যোগ দেয়।
কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানের পর। বিশ্বের নজর যেন আইএস-এর দিকেই সরে যায়। আর আলেপ্পো জুড়ে সেনা আর বিদ্রোহীদের ঘাত-প্রতিঘাত চলতে থাকে। মাঝে দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে আটকে পড়ে কয়েক লাখ সাধারণ মানুষ।
আইএস যতই ক্ষমতাশালী হয়েছে ততই বিশ্বের নজর আলেপ্পো থেকে সরে যায়। আর ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মির অর্থ আর অস্ত্রের যোগানে ভাটা পড়ে। লড়াইটা ক্রমাগত ত্রিমুখী হয়ে যায়।‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে এক দিকে সিরিয়ার সেনার সঙ্গে লড়তে হয়েছে। অন্যদিকে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে আইএস-এর বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে।
তার পরেও হয়তো বিদ্রোহ চলত পারতো। কিন্তু সমস্ত হিসাব পাল্টে দেয় রাশিয়া। আসাদের সমর্থনে রাশিয়ার তার সৈন্যদের যুদ্ধে নামায় সিরিয়ায়। আর রুশ সেনাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আইএস নয় ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’। রাশিয়ার বিমান সেনাদের প্রবল হানায় কার্যত অসহায় ছিল ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’। সিরিয়ার সেনাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয় ইরানের শিয়া মিলিশিয়ারাও। এই চাপ সামালানো অসম্ভব ছিল ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মির। তারপরেও সেভাবে সাহায্য জোটেনি ব্রিদাহীদের। শুধু মাঝে আটকে থাকা নাগরিকদের উদ্ধারের জন্য সরব হয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সরব হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। ত্রাণ পৌছেছে। কিন্তু ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মির হাত শক্ত করার কোনও উদ্যোগ ছিল না তেমন। আলেপ্পো ও সন্নিহিত এলাকায় ক্রমেই জোরালো হতে থাকে আসাদ বাহিনীর প্রভাব।
আসাদের সেই প্রভাব একচ্ছত্র হতে চলেছে আলোপ্পো জয়ের মধ্যদিয়ে। সিরিয়াকে আসাদ বিহীন করার পশ্চিমা মিশন আপাতত ব্যর্থ। এর মধ্যদিয়ে নতুন বছরের সূচনায় আবারও একটি জয় নিজের পকেটে ভরলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন।