আয়না২৪ ডেস্ক
ফের ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা চালালো উত্তর কোরিয়া। দেশটির ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বিশ্বের শক্তিশালী কয়েকটি দেশ যখন উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে ঠিক তখনই এই পরীক্ষা চালানো হল । মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হুশিয়ারি উপেক্ষা করেই এই পরীক্ষা চালানোর নির্দেশ দেন কিম জং উন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠকের ঠিক আগের দিন এই পরীক্ষা চালিয়ে একটা কঠোর বার্তা দিয়েছে দেশটি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শি জিনপিংয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরে উত্তর কোরিয়ার বেপরোয়া এই মনোভাব গুরুত্ব পাবে। গতকাল বুধবার জাপান সাগরে এই ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হয়। ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষার পরই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাপান। জানা গেছে, পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্পে অর্থ জোগান দিতে দেশটির হ্যাকাররা অন্তত ১৮ টি দেশের ব্যাংকে সাইবার হামলার লক্ষ্য স্থির করেছে। –খবর সিএনএন, বিবিসি ও ডেইলি মেইল অনলাইনের।
উত্তর কোরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বন্দর সিনপো থেকে পরীক্ষা চালানোর পরে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রায় ৬০ কিলোমিটার (৩৭ মাইল) দূরে গিয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কেএন-১৫ মধ্যম পাল্লার এই ক্ষেপনাস্ত্রটি গতকাল সিউল সময় সকাল ৬টা ৪২ মিনিটে সাউথ হ্যামজিয়ং প্রদেশের সিনপো থেকে উৎক্ষেপন করা হয়। এই ক্ষেপণাস্ত্র ১৮৯ কি.মি (১১৭ মাইল) পাড়ি দিয়ে শত্রুপক্ষকে আক্রমন করতে পারে।
ইউএস প্যাসিফিক কমান্ডের কমান্ডার ডেভ বেনহাম জানিয়েছেন, ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা ৯ মিনিটের জন্য ট্র্যাক করা হয়েছিল এবং এটা উত্তর আমেরিকার জন্য বিপজ্জনক নয়। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ এসব তথ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ইস্ট এশিয়া ননপ্রোলিফারেশন প্রোগ্রামের ম্যালিসা হ্যানহাম বলেন, এসব তথ্য সঠিক হলে বুঝতে হবে উত্তর কোরিয়া বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির একটি ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে যে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল তার চেয়েও এটা কম উন্নত।
অস্ট্রেলিয়ার লভি ইনস্টিটিউটের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক ইউয়ান গ্রাহাম বলেন, এর মাধ্যমে কিম জং উন হয়তো ট্রাম্প এবং শি জিনপিংকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখালো। লা ট্রোব এশিয়ার পরিচালক নিক বিসলে বলেন, উত্তর কোরিয়াকে একটি জন্ম নেওয়া শিশু মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ দেশটি যা করছে তা একটি লক্ষ্য নিয়েই করছে। তারা পরমাণু অস্ত্র সংযুক্ত ব্যালিস্টিক মিসাইল তৈরির দিকেই যাচ্ছে।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিনপো শিপইয়ার্ডটি উত্তর কোরিয়া যুদ্ধজাহাজ কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এখানে তার নজরদারি বাড়িয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, এই ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষায় মোবাইল লাঞ্চার থেকে সলিড ফুয়েলড রকেট ব্যবহার করা হয়েছে। হাওয়াই প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং ইউএস প্যাসিফিক কমান্ডের যৌথ গোয়েন্দা দপ্তরের সাবেক পরিচালক কার্ল সুস্টার বলেন, মোবাইল লাঞ্চারের একটা সমস্যা হলো, হামলার আগে এটা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। একটা টানেল থেকে সংক্ষিপ্ত সময়ের নোটিশে নিক্ষেপ করা যায়। লিকুইড ফুয়েলের চেয়ে সলিড ফুয়েলের সুবিধা এই যে, ক্ষেপনাস্ত্রের ঘূর্ণন এবং উেক্ষপণে এটা বেশি সহায়তা করে। এর ফলে এটাকে পর্যবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সূত্র মতে, কিম জং উন তার ক্ষমতার প্রথম পাঁচ বছরে যতো ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছেন তা তার বাবার ১৭ বছরের শাসনামলের চেয়েও দ্বিগুন। গত দুই বছরে উত্তর কোরিয়া পাঁচটি পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশটি এখনো নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড এর উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি যা ক্ষেপনাস্ত্রে সংযুক্ত করা যায়। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মাইকেল হেডেন বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আন্ত:মহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র তৈরি করতে পারে উত্তর কোরিয়া যা যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে আঘাত হানতে সক্ষম হবে।
যে কোনো ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু পরীক্ষা চালাতে উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যদিও পিয়ংইয়ং এ নিষেধাজ্ঞা প্রায়ই লঙ্ঘন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়া নিয়ে অনেক মন্তব্য করেছে। এখন আর কোনো মন্তব্য নয়। তবে দেশটির সামরিক বাহিনীর প্যাসিফিক কমান্ড বলেছেন, ক্ষেপণাস্ত্রটি ছিল মধ্যম পাল্লার।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিয়িং এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের যে কোনো নীতির লঙ্ঘনের বিরোধিতা করে চীন। তিনি এই ধরনের পদক্ষেপ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশকে বিরত থাকার আহবান জানান। দক্ষিণ কোরিয়ার ইউনিফিকেশন মিনিস্ট্রি’র মুখপাত্র লি ডাক হেং বলেন, ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষার নিন্দা জানিয়েছেন এবং নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকার আহবান জানিয়েছেন।
এদিকে গত মঙ্গলবারই হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, সময় শেষ। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেটাই এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয়। গত রোববার এই সুরে সুর মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, চীন যদি সহায়তা না করে তাহলে উত্তর কোরিয়াকে একাই সামলাবে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি যে কোনো মূল্যে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু প্রকল্প বন্ধ করারও আহবান জানান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গতকালের ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র যে ২৩ শব্দের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তা আগের চেয়ে ভিন্নতর। অথচ এই ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে কিম জং উন বলতে গেলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও শি জিনপিংকে তিরস্কারই করেছেন।