আইএস যোদ্ধার প্রেমের ফাঁদে পড়া এক মিতাতের গল্প

Spread the love

আয়না২৪ ডেস্ক

 ইসলাম মিতাতের  বাড়ি মরক্কোয়। বছর কয়েক  আগে ডেটিং সাইটের মাধ্যমে পরিচয় হয় আফগান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক আহমেদ খলীলের সঙ্গে। পরিচয়ের সূত্রে ভাললাগা, ভালবাসা এবং সেই সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায়।এরপর বদলে যায় মেয়েটির জীবন। স্বামীর হাত ধরে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের আস্তানায় চলে যায় মিতাত । তিন আইএস যোদ্ধার স্ত্রী আর দুই সন্তানের মা হয়ে সেই আস্তানা থেকে ফিরে এসেছেন তিনি।মিতাত এখন সিরিয়ায়   আছেন আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইরত কুর্দি সেনাদের  একটি আশ্রয় শিবিরে। প্রেমের ফাঁদে পড়ে আইএস-বধূ হওয়া এবং সেখান থেকে মুক্তির গল্প তিনি শুনিয়েছেন সিএনএনকে।

প্রেম থেকে বিয়ে সম্পর্কে মিতাত বলেন, মুসলিমা ডট কম ওয়েবসাইটের মাধ্যমে খলীলের সঙ্গে  পরিচয়। ব্রিটিশ জানার পর খলীলের ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ বাড়ে। কারণ, মিতাত  ফ্যাশন ডিজাইনার হতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ব্রিটিশ কাউকে বিয়ে করলে তাঁর স্বপ্নপূরণে পথটা সহজ হবে। খলীলের পক্ষ  থেকেও তাঁকে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখানো হয়। সব মিলিয়ে দুজনের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর কয়েক মাস পর খলীল তাঁর বোন পরিচয় দিয়ে এক নারীকে নিয়ে মরক্কোয় তাঁদের বাড়ি যান এবং তাঁকে  বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কতটা সচ্ছল, তা প্রমাণের জন্য তাঁরা ব্যাংক হিসাবও নিয়ে যান। এরপর বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের পর পর দুবাই হয়ে আফগানিস্তানের জালালাবাদে যান তাঁরা। সেখানে মাস খানেক থাকার পর নিরাপত্তার কারণে মরক্কোতে ফিরে যান।

এরপর খলীল দুবাই থেকে মিতাতকে আকষ্মিক  ফোন করে বলেন, তুরস্কে একটি চাকরি জুটেছে তাঁর।  তাই সেখানে যাবেন তাঁরা; একসঙ্গে ছুটি কাটাবেন,  ঘোরাঘুরি করবেন, অনেক মজা করবেন। সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে মিতাত যাত্রা  করেন তুরস্কে। কিন্তু মিতাত  সেখানে পৌঁছানোর পর খলীল তাঁকে নিয়ে কোনো রিসোর্ট বা হোটেলে ওঠেনি। সরাসরি চলে যান সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের গাজিয়ানতেপ এলাকায়।

মিতাত বলেন ‘যে বাড়িতে আমরা  উঠলাম, সেটা নারী-পুরুষ আর শিশুতে ঠাসা ছিল।   একটা ঘরে পুরুষেরা, আরেকটা ঘরে নারী ও শিশুরা। আমি খুব অবাক হলাম এই দৃশ্য দেখে। সেখানে অব্যাগতদের কাছে জানতে চাইলাম, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে তাঁরা বলেন যে তাঁরা হিজরতে যাচ্ছেন। বিষয়টি  আমি খলীলের কাছে জানতে চাইলাম। এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলাম। শুনে সে ভীষণ খেপল। খলীল বলল, তুমি আমার স্ত্রী। তোমাকে আমার সব কথা মানতে হবে।’ তিনি ভেবেছিলেন, সীমান্তে তুরস্কের কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়ে নিজ দেশে ফেরত যাবেন। তবে সীমান্তে পৌঁছানোর পর তাঁদের বহরকে দেখে গুলি চালানো হল। প্রাণ বাঁচাতে অন্যদের মতো মিতাতও সিরিয়ায় ঢুকে পড়েন।

সিরিয়ার সেই কঠিন দিনগুলোর বিষয়ে  মিতাত বলেন, সিরিয়ায় গিয়ে তাঁরা জারাব্লুস শহরের কাছাকাছি একটি আস্তানায় ওঠেন। সেখানে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, তিউনিসিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া ও সৌদি আরব থেকে আসা লোকজন ছিল। তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন আর তাঁর স্বামীকে এক মাসের সশস্ত্র প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে খলীলকে যুদ্ধে পাঠাল আইএস। এরপর প্রথম দিনই কোবানিতে তুমুল লড়াইয়ে মারা যান খলীল। খলীলের যে ভাই আইএসে যোগ দিয়ে পরিবারসহ সিরিয়ায় ছিলেন, তিনিও  মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর খবরে   অথই সাগরে পড়েন মিতাত। কিন্তু সেখানে থেকে  পালানোর কোনো  পথই ছিল না মিতাতের। ওই আস্তানাতেই তাঁর সন্তান আবদুল্লাহর জন্ম হয়।

আইএসের লোকজন আবার বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে থাকে মিতাতকে। একসময় প্রথম স্বামী খলীলের বন্ধু জার্মানির আবু তালহা আল-আলামিনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তালহা তাঁকে আলেপ্পোর মানবিজে নিয়ে যান। তবে তিনি তাঁকে কড়া শাসনে রাখতেন, বাড়ি থেকে বের হতে দিতেন না। এরপর তাঁকে তালাক দেন মিতাত। ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন , তবে সে চেষ্টা সফল হয়নি।  মিতাতের  ভাষ্য, এ কাজে কেউ সহায়তা করতে চায়নি তাঁকে ।  কারণ, ধরা পড়লেই শিরশ্ছেদ করা হবে এই ভয়ে।

তৃতীয়বারের মতো মিতাতকে বিয়ে দেওয়া হয় আবু আবদুল্লাহ আল-আফগানি নামের এক আইএস যোদ্ধার সঙ্গে। মিতাতের বলেন, আবু আবদুল্লাহ ভারতীয়। তাঁর মা অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। সেই সূত্রে আবু আবদুল্লাহ সম্ভবত তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ছিলেন। এই সংসারে মারিয়া নামের একটি মেয়ে আছে। তবে লড়াই করতে গিয়ে মারা যান তৃতীয় স্বামী আবু আবদুল্লাহও। এরপর পালানোর সুযোগ আসে মিতাতের কাছে। পাচারকারীদের অর্থ দিয়ে সন্তানদের নিয়ে তিনি কুর্দিদের তল্লাশিচৌকিতে পৌঁছে যান।

দুই বছরের আবদুল্লাহ ও ১০ মাসের মারিয়াকেসহ মিতাতকে সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইরত পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটের (ওয়াইপিজি) আশ্রয়শিবিরে রাখা হয়। এটি সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। সন্তানদের নিয়ে মিতাত এখন সেখানেই আছেন। তাদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে লেবাননের বৈরুতে মরক্কো দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ   এখনো  কোনো সাড়া দেয়নি।

মিতাতের বাবা আশা করছেন, মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ তাঁর মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।

তবে দেশে ফেরার চেয়ে সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তিত মিতাত । তাঁর আশা, প্রথম সন্তানের বাবা ব্রিটিশ হওয়ায় তাঁরা ব্রিটিশ পাসপোর্ট পেতে পারেন। কিংবা তৃতীয় স্বামীর পরিবারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায়ও থাকতে পারেন তাঁরা। তবে শেষ পর্যন্ত কোথায় ঠাঁই হবে, তা নিয়ে অনিশ্চিত  মিতাত।  ্এই অনিশ্চয়তা থেকেই মিতাত বললেন,‘ জানি না আমি যাব  কোথায়। আমি কিছুই  জানি না। আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেছে।’