আন্তর্জাতিক ডেস্ক
দুর্নীতির অভিযোগে চলছে মন্ত্রীদের ধরপাকড়, অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীতে বড় ধরনের রদবদলের ঘটনা ঘটে গেল শনিবার। এর একদিনের মাথায় যুদ্ধকবলিত ইয়েমেন সীমান্তের কাছে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন এক যুবরাজ। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশ সৌদি আরবের রাজতন্ত্রের পালাবদল ও সংকট নিয়ে আলোচনায় তীব্রতর হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে এসব ঘটনা নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর নেই। সৌদিপন্থী বিশ্লেষক বলছেন, এটা বাণিজ্য উদারীকরণের মধ্য দিয়ে নতুন অর্থনীতিতে প্রবেশের রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া। বিপরীতে অন্যরা একে দেখছেন রাজপরিবারের ক্ষমতাকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব হিসেবে।
তাঁরা মনে করছেন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে সৌদি যুবরাজের বাদশাহ হওয়ার পথ নিরঙ্কুশ করতেই গ্রেপ্তার ও রদবদলের এমন পদক্ষেপ। সবমিলে সৌদি রাজতন্ত্রের সংকটকেই সামনে এনেছেন তাঁরা।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সামরিক অভিযানে সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ঘরহীন হয়ে পড়েছেন ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ। শনিবার রিয়াদের কিং খালিদ বিমানবন্দর লক্ষ্য করে ইয়েমেনের বিদ্রোহী হুতি গ্রুপের ছোঁড়া মিসাইল প্রতিহত করেছে সৌদি আরব। এদিকে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সৌদি আরব সফরে গিয়ে নিজের পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। অনেকেই তার আকস্মিক এই সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্তে দেশটি আরেকটি রাজনৈতিক সংকটে পড়বে।
এরপর শনিবার রাতে সৌদি যুবরাজের নেতৃত্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন রাজপরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। রাজপুত্র, মন্ত্রী ও বিখ্যাত ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গ্রেফতার করা হয়। অনেকের দাবি, রাজসিহাংসনে নিজের অবস্থান সুসংহত করতেই এমন অভিযান চালাচ্ছেন সালমান বিন আব্দুল্লাহ। এদিকে পৃথক এক ঘটনায় আসির প্রদেশের গভর্নর প্রিন্স মানসুর বিন মুকরিন ইয়েমেন সীমান্তে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাও ছিলেন। তিনি সাবেক যুবরাজের ছেলে। তার এই মৃত্যুকে ঘিরেও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
শনিবারের গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন মিতেব বিন আব্দুল্লাহ। সাবেক রাজা আব্দুল্লাহর প্রিয় ছেলে এখন এলিট সৌদি ন্যাশনাল গার্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এছাড়া প্রিন্স আওয়ালিদ বিন তালালকে গ্রেফতারে বড় প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতিতে। বিখ্যাত এই ধনকুবেরকে গ্রেফতার করায় ধস নেমেছে সৌদি স্টক এক্সচেঞ্জে। তালাল বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং সৌদি আরবের শীর্ষ ধনী। পশ্চিমা বেশ কিছু বড় কোম্পানিতে তার শেয়ার রয়েছে।
সৌদি আরবের জারিকৃত এক রাজ ডিক্রিতে বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতির মূল উৎপাটন না করতে পারলে এবং দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা না গেলে মাতৃভূমির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যাবে না।’ সন্ধ্যায় সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়ে নতুন এক দুর্নীতিবিরোধী কমিটি গঠন করেন। সৌদি আরবের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা এসপিএ জানিয়েছে, যুবরাজকে প্রধান করে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে সেখানে যুবরাজ চাইলে যে কাউকে গ্রেফতার করার এবং যে কারও উপরে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করার ক্ষমতা রাখেন।
ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক কারিম ফাহিম এক সময় বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে সৌদি আরবে এই গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। সৌদি রাজপরিবার তাদের অর্থনীতিকে চাঙা করতে তেলের ওপর থেকে নির্ভরতা সরিয়ে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের বাণিজ্যের জন্য আকৃষ্ট করছে। কারণ দেশটির তরুণ প্রজন্মের মাঝে হতাশা তৈরি হয়েছে যে সব ক্ষমতাই সৌদি রাজপরিবার ও তাদের মিত্রদের হাতে।’
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের ডেভিড কির্কপ্যাট্রিক বলেছেন, সৌদি আরবের নির্বাহী রাজতন্ত্রের কোনও লিখিত সংবিধান নেই। কিংবা পার্লামেন্ট বা আদালতের দ্বারা সিদ্ধ কোনও বিধিও নেই। তাই দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখা এখানে খুবই কঠিন। তিনি বলেন, ‘জনগণের টাকা ও রাজপরিবারের সম্পদের সম্পর্ক এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যান্য দেশ এটা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার বিষয়টি কঠিন।’
শনিবার সকালে সৌদি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাদশাহ সালমানের এক বিবৃতিতে প্রকাশ করে। যেখানে ঘোষণা দেওয়া হয় যে যুবরাজ আব্দুল্লাহ বিন সালমানের নেতৃত্বে একটি দুর্নীতি দমন কমিশন গড়ে তোলা হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি, সাধারণ জনগণের কল্যাণে নয় বরং নিজেদের স্বার্থ হাসিলেই এই কমিশন গঠন করা হয়েছে। আর প্রিন্সদের আটকের বিষয়টি এক বছরের বেশি সময় ধরে পরিকল্পনা করা হচ্ছিলো বলে দাবি করে ওয়াশিংটন পোস্ট।
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এই ‘ধরপাকড়’কে রাজ পরিবারের একটি বার্তা বলে মনে করছেন। এর মাধ্যমে ধনী ও ক্ষমতাশালীদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে নতুন ধারা শুরু করতে যাচ্ছে সৌদি আরব। আরাবিয়া ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আলি শিহাবি বলেছেন, ‘অনেকে একে ক্ষমতার খেলা বলছেন। তবে আদতে এটি জনগণের কাছে বার্তা যে নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে সৌদি আরব।’ তিনি বলেন, কয়েক দশক ধরে চলে আসা ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলবে এই পদক্ষেপ।’
আবার অনেকের মতে, এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র যুবরাজের ক্ষমতাগ্রহণের প্রয়াস ছাড়া আর কিছু নয়। নিজের অবস্থান সুসংহত করতেই তিনি এমনটা করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগে রাজনীতি বিশ্লেষকদের। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ব্রুস রিডেল বলেন, ‘সৌদি রাজনীতির অভ্যন্তরীণ গবেষক ও পর্যবেক্ষরা এই পদক্ষেপকে রাজপরিবারের কোন্দল মনে করছেন। কারণ এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই যে মোহাম্মদ বিন সালমানের মৃত্যুর খুব সহজেই সিংহাসনে বসতে পারবেন যুবরাজ সালমান। আর এই গ্রেফতার বিষয়টা আরও স্পষ্ট যে উত্তরাধিকার প্রক্রিয়া বাদশা ও তার সন্তান যেমন চান তার চেয়ে অনেক কঠিন।’
কনজারভেটিভ আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট এর স্কলার অ্যান্ড্রু বাওয়েন এই ঘটনাকে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। টুডে’র ওয়ার্ল্ডভিউকে তিনি বলেন, ‘শি জিনপিংয়ের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে শুধু কমিউনিস্ট পার্টির দুর্নীতিই কমানো হয়নি বরং নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য অনেক প্রতিপক্ষকেও দমন করা হয়েছে।’
অভ্যন্তরীণ এই রাজনীতি ছাড়াও বৈদেশিক নীতিতেও শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন সৌদি যুবরাজ। ইরানের মুখোমুখিও হয়েছেন তিনি। আর একারণেই হয়তো লেবানিজ প্রধানমন্ত্রী হারিরি পদত্যাগ করেছেন। হারিরি সৌদি মিত্র হলেও ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর পক্ষ নিয়েছিলো। পদত্যাগের পর গুঞ্জন উঠে যে ইরানি এজেন্টরা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো, সৌদি কর্মকর্তারা তাকে পদত্যাগ বাধ্য করেছিলো। কিন্তু প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। হারিরি অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছেন লেবানন নিয়ে ইরানের অবস্থানকে। তিনি অভিযোগ করেন, ইরান হিজবুল্লাহর মাধ্যম রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ তার এই পদত্যাগের সমালোচনা করে বলেছেন তিনি জানার জন্য অপেক্ষা করবেন যে ঠিক কী কারণে সৌদি আরব তাকে পদত্যাগে বাধ্য করলো।
যুবরাজকে সমর্থন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও। ইরান বিরোধী অবস্থান ও সৌদি আরবের মিত্র হওয়ায় ট্রাম্প বরাবরই যুবরাজের সঙ্গে ছিলেন। রবিবার এশিয়া সফরের সময় হুতি মিসাইল হামলা নিয়ে তিনি দাবি করেন যে ইরান এই হামলা চালিয়েছে। কাতারকে বিচ্ছিন্ন করার সময়ও ট্রাম্প রিয়াদকে সমর্থন দিয়েছেন। তবে রিডল মনে করেন, বর্তমান অবস্থা সংকটপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘রাজপরিবারের মাধে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। তেলের দাম সর্বনিম্ন, ইয়েমেন যুদ্ধেও কোনও ফলাফল নিশ্চিত নয়, কাতারের উপর নিষেধাজ্ঞাও ব্যর্থ, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে এখনও ইরানের প্রভাব রয়েছে এবং উত্তরাধিকার প্রক্রিয়াও এখন প্রশ্নবিদ্ধ।’ অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পর সৌদি আরব তাদের সবচেয়ে সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।