নিজস্ব প্রতিবেদক
ভারতের প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটতে ‘বিষকন্যা’ শব্দটি বার বার ঘুরে ফিরে আসে। প্রাচীন ভারতের সাহিত্যেও ‘বিষকন্যা’ কথা আছে। কথিত আছে, প্রাচীনকালে রাজনৈতিক প্রয়োজনে কিছু নারীকে একেবারে শৈশব থেকে অল্প পরিমাণ বিষ খাওয়াতে খাওয়াতে বড় করে তোলা হত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিষের মাত্রাও বাড়ত। যৌবনপ্রাপ্তির পরে সে পরিপূর্ণ বিষকন্যা হয়ে উঠত। তার সংস্রবে কোনো পুরুষ এলে তার পরিণতি ছিল অনিবার্য মৃত্যু। ‘সংস্রব’ মানে অবশ্যই যৌন সংসর্গ। বলাই বাহুল্য, বিষকন্যারা দারুণ সুন্দরী হতেন। তাঁদের রূপে মোহগ্রস্ত করে রাজা বা রাজপুরুষদের গুপ্তহত্যার চেষ্টা করত বিপক্ষ শক্তি।
বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, এমনকী, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে জানা যায়, ষোড়শ মহাজনপদের কালে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যখন অঙ্গ, কোশল, কাঞ্চী, অবন্তী ইত্যাদিকে এমন ছলেই পরাভূত করে মগধের প্রবল উত্থান ঘটছিল। তখন বিষকন্যারা উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। বিশেষত, নন্দ বংশের আমলে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। সেই সময়ে রাজা ও রাজপুরুষদের হত্যা করে গোলযোগ তৈরি ছিল এক নৈমিত্তিক ঘটনা।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক কহিনিগুলিতেও বার বার ছায়াপাত ঘটেছে বিষকন্যাদের। এই মরমী লেখক লিখে গিয়েছেন বিষকন্যাদের প্রেম, রাজপুরুষদের রিরংসা এবং ক্রূরবুদ্ধি রাজনীতিকদের কথা। ইসলাম আগমনের পরে রাজনৈতিক ছক বদলে যায়। বিষকন্যারাও শুধুমাত্র কিংবদন্তির বাসিন্দা হয়ে পড়েন। বাস্তবে তাঁদের আর দেখা পাওয়া যায়নি।
চাণক্য নীতি অনুযায়ী, বয়স্ক কোনও পুরুষ যদি তরুণী ভার্যা গ্রহণে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়েন, তবে তিনি বিষের পেয়েলায় চুমুক দিতে চলেছেন (বৃদ্ধস্য তরুণী বিষম)। বিবাহে সমতা বিষয়টি একান্তভাবে প্রয়োজন। বয়সের বিপুল ফারাক বিবাহকে চরম অসুখী করে জীবনকে বিষময় করে তুলতে পারে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সি স্ত্রীকে কেবল শারীরিকভাবে তুষ্ট রাখা নয়, তার অন্যান্য চাহিদাগুলিকেও মান্যতা দেওয়া বয়স্ক স্বামীর পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়ায় বলে জানায় চাণক্য নীতি। এমতাবস্থায় স্ত্রীও পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তিনি যে সর্বদা স্বৈরিণী হয়ে উঠবেন, এমন নয়। কিন্তু তাঁর কাছে সংসার তখন বিষময়। এমন পরিস্থিতিতে তিনিও আবির্ভূত হন ‘বিষকন্যা’ হিসেবে।
কিন্তু, ‘বিষকন্যা’ শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে না-দেখলে অন্য কিছু দ্যোতনা প্রতীয়মান হয়। এমনটাই বলে গিয়েছেন কৌটিল্য বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। ভারতের সর্বত্র প্রচলিত নৈতির প্রবচন ‘চাণক্য নীতি’-তে জানানো হয়েছে, ‘বিষকন্যা’ শব্দটি অনেক সময়েই একটি অভিধা এবং যুগে যুগে বিষকন্যারা পুরুষের সর্বনাশ করতে সক্রিয় থাকেন। বা এমনটাও বলা যায়, পুরুষের লালসাই অনেক সময়ে সাধারণ নারীকেও ‘বিষকন্যা’ করে তোলে।