ঝালকাঠি প্রতিনিধি
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১০ বছর অতিবাহিত হলেও আজো অরক্ষিত উপকূলবাসী। এতোগুলো বছর পেড়িয়ে গেলেও সিডরে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলো মেরামত করা হয়নি। অল্প উচ্চতার জোয়ারেই বিশখালী নদীপাড়ের ফসলি জমি তলিয়ে যায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে বারবার ধর্না দিয়েও কোন সুফল পায়নি বিশখালী নদী তীরবর্তী রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলার সাধারন মানুষ। জেলা পানি উন্নয়ান বোর্ড কিছু স্থানে নতুন করে বাঁধ নির্মান করলেও ক্ষতিগ্রস্থ পুরনো বাঁধগুলো আজো মেরামত হয়নি।
ভয়াল সেই প্রলয়ের কথা ঝালকাঠিবাসী তথা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছে আজো দুঃস্বপ্নময় স্মৃতি। ২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বর, শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় অঞ্চল লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। উপকূলীয় অঞ্চলের হাজারো মানুষের মৃত্যু ও লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়েছিল। এখনো নিখোঁজ রয়েছে বহু মানুষ। আগের দিনও যে জনপদ ছিল মানুষের কোলাহলে মুখরিত, মাঠ জুড়ে ছিল কাঁচা-পাকা সোঁনালি ধানের সমারোহ, পরের দিনই সেই চির চেনা জনপথ লাখ মানুষের আর্তচিৎকারে পালটে যায়।
১৪ নভেম্বর সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। নিম্নচাপটি কয়েক বার গতি পরিবর্তন করে মধ্যরাতে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। রাতে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ঝালকাঠি, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় অঞ্চলে। ঝড়ের তীব্রতা কমে যাওয়ার পর ১৫ নভেম্বর সকাল থেকে শুরু হয় উপকূলবাসীর যন্ত্রনাদায়ক অধ্যায়। ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি জেগে আছে স্বজনহারাদের মাঝে। সেই দুঃস্বপ্নময় স্মৃতি আজও তাড়া করে ফেরে উপকূলবাসীকে।
উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির প্রায় ৭ লাখ মানুষ সেদিন কোন না কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলেন। সিডরের ১০ বছরে উপজেলাবাসী ঘুরে দাড়ালেও বিভিন্ন স্থানে রয়ে গেছে নানা ক্ষত। তাইত ঘুর্ণিঝরের সতর্ক বার্তা পেলেই আতংকিত হয়ে পরে বিষখালী বেস্টিত জেলার রাজাপুর ও কাঁঠালিয়ার মানুষ। বিষখালির নদীর সেই বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলো আজও সংস্থার করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বেড়িবাঁধ না থাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অধিক উচ্চতার জোয়ার হলেই বাড়িঘর ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়। এখনও নির্মান হয়নি পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র বা সাইক্লোন সেল্টার। ২৪০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঘুর্ণিঝড় এবং ১০ফুট উচু জলোচ্ছাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল বিষখালী নদী বেষ্টিত রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলা। সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ এই দুই উপজেলার মানুষদের নিরাপত্তায় সিডরের ১০ বছর পরেও তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
কাঁঠালিয়া উপজেরার সৌলজালিয়া গ্রামের কৃষক কফিল উদ্দিন বলেন, “আসমানে ম্যাগ (মেঘ) দ্যাখলেই মনে পড়ে সিডরের কথা। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করি কিন্তু মোগো এহানে কোন আশ্রয়কেন্দ্র নাই। সরকার যদি একটা আশ্রয়কেন্দ্র দেতে তয় নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম”।
রাজাপুর উপজেলার বড়ইয়া গ্রামের জেলে হাসেম আলী বলেন, “গাঙ্গে যদি বেশি পানি দেহি তয় হেদিন আর গাঙ্গে যাই না। সিডরের দিন এই বিশখালীর যে চেহারা দেখছি হেয়া আইজো ভুলিনাই। সিডরের তুফানে বেড়িবাঁধগুলা সব তছনছ অইয়া গেছে। গাঙ্গে বেশি পানি অইলে ধানক্ষ্যাত পানিতে তলাইয়া যায়।”।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখনো এই অঞ্চনের মানুষের বসতভিটা ও মাঠের ফসল নিয়ে চরম হতাশায় দিন কাটে। বেড়িবাঁধ এবং আশ্রয় কেন্দ্রের দাবি তাদের বহু দিনের, বহু মহলে ধর্ণা দিয়েও কোন কাজ হয়নি। সিডরের আঘাতে এ জেলায় মারা যায় ৪৭ জন, আহত হয় ১২ হাজার ২০৬ জন। ৭৪৩ দশমিক ৯৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ঘরবাড়ী, গাছপালা, ক্ষেতের ফসল, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সড়ক, বাঁধ সবকিছুই লন্ড-ভন্ড হয়ে যায়। এক হাজার ৪৫৭ কি:মি কাঁচা-পাকা সড়ক, ৬২ কি:মি বাঁধ এবং ২০টি সেতু বিদ্ধস্ত হয়। সে ক্ষত আজও রয়েছে গেছে জেলার বিভিন্ন স্থানে।
কাঁঠালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ মো. ফয়েজুল আলম বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ মেরামত ও নতুন বাঁধ নির্মানের জন্য আমরা উপর মহলকে অবহিত করেছি। আশাকরি দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হবে। তিনি আরো বলেন, কাঁঠালিয়ায় ইতিমধ্যে ১০টি আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। এছাড়া আরো ৩টি আশ্রয়কেন্দ্রের কাজ অচিরেই শুরু হবে।