নিজস্ব প্রতিবেদক
‘হোমকে গাঙ, পিছে খাল, উত্তরে দক্ষিণে ধারে কাছে কোনোহানে একটা একটা বিল্ডিং নাই, বাতাস ছোডলেই কইলজা কাইপ্পা ওডে, বইন্যা আইলে কুম্মে যাইয়া এট্টু আশ্রয় লমু, পরানডারেও বাঁচামু’। সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধ আশ্রাফ আলীর চোখেমুখে ভীতি। বয়সের ভারে ন্যুজ এই বৃদ্ধের চোখেমুখে শংকার ছাপ। পাথরঘাটার কালমেঘা ইউনিয়নের দক্ষিণ কুপদোন গ্রামের বাসিন্দা আশ্রাফ আলী আকন। বিষখালীর তীর ঘেঁেষ গ্রামটিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস। অদূরে বিষখালী পাড় ভেঙে ক্রমঃশ লোকলয়ে প্রবেশ করছে। পেছনে খাল, উত্তর ও দক্ষিনে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ঘূণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের দেখা মেলেনা। ভয়াল সিডরে এই গ্রামেরই ৫জন প্রান হারিয়েছিল। এদের প্রত্যেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে বানের জলে ভেসে ডুবে মরেছে। সিডরের ১০ বছর পেরুলেও পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মান হয়নি উপকূলে। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সংকেতে এলেই শংকিত হয়ে পড়েন এ অঞ্চলের বাসিন্দারা।
জেলা প্রশাসনের সবশেষ তথ্যমতে জেলায় মোট ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা ৩৫১টি। জেলার ১২ লাখ মানুষের মোট দেড়লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে এসব কেন্দ্রে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের অপর্যাপ্ততার ফলে সংকেত এলেই শংকিত হয়ে পড়েন অনেকেই। সিডরে সবচেয়ে বেশি প্রান ও সম্পদহানী হয় নদী তীরবর্তি এলাকার বাসিন্দাদের। কিন্ত ১০ বছর পেরুলেও এখনো এসব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয় কেন্দ্র নির্মান হয়নি। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত এলেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এলাকার বয়োবৃদ্ধ নারী শিশু। দক্ষিণ কুপদোন গ্রামের বাসিন্দা রুস্তম আলীর স্ত্রী ময়না বেগম বলেন, ‘কয়দিন আগে মোড়া বইন্যার সংকেত দেছে। ডরের চোডে নাওয়া খাওয়া বন্ধ অইয়া গেছিল, গুরাগারা লইয়া কুম্মে যাইয়া উইট্টা পড়ানডা বাঁচামু’। ঠিক একইভাবে বিষখালী বলেশ^র ও পায়রার তীর ঘেঁেষ বসবাসরত বরগুনার বিশাল এক জনগোষ্ঠিকে দূর্যোগে অনিরাপদ হয়ে পরেন। দুরবর্তি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে ছুটোছুটি করতে গিয়ে প্রানহানী ঘটে নারী শিশু বৃদ্ধদের। উপকূলীয় এলাকার দুর্যোগ ঝুঁিক নিরসনে কাজ করছেন এমন বরগুনার বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন এনএসএস এর নির্বাহী পরিচালক সাহাবুদ্দিন পান্না বলেন, দূর্যোগপ্রবন বরগুনার জেলার অপেক্ষাকৃত নদী বিধৌত এলাকার বাসিন্দাদের দূর্যোগকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সিডরের ১০ বছর পরে পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র নির্মান করা হয়নি। এখনো বড় কোনো দূর্যোগের সংকেত দেয়া হলে এখানকার বাসিন্দারা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে থাকেন। আমি মনে করি এই এলাকার আরো বেশ কিছু আশ্রয় কেন্দ্র নির্মানে জরুরী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
নদী তীরবর্তি গ্রামবাসীর দাবি,দূর্যোগকালীন নিরপদ আশ্রয়ের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র নির্মান করা হোক। পাথরঘাটার কালমেঘা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকন মোঃ শহীদ বলেন, বিষখালীর তীর ঘেঁষে আমার ইউনিয়নের অর্ধলক্ষাধিক মানুষের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ মানুষের বসবাস নদী তীরে। ঘূণিঝড়ে আশ্রয় নেয়ার জন্য এদের মাত্র ছয়টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। দূর্যোগের সময় এসব মানুষদেও আশ্রয় দিতে হিমশিম খেতে হয়। নদী তীরের বাসিন্দাদের অন্তত এক কিলোমিটার ব্যবধানে আশ্রয় কেন্দ নির্মান করা হলে এসব মানুষদের দূর্যোগের সময় নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব।
উপকূলীয় উন্নয়ন সংগঠন ‘জাগো নারী’র প্রধান নিবার্হী হোসনে আরা হাসি বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিডরে আমরা দেখেছি উপকূলের মানুষ কতটা অনিরাপদ। এরপর ১০ বছর কেটেছে কিন্তু উপকূলীয় বাসিন্দাদের দূর্যোগকালীণ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। সমুদ্রোপকূলীয় দূর্যোগ প্রবন জেলা বরগুনার দূর্যোগ ঝুঁকিতে বসবাসরত মানুষদের জন্য আরও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মানে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি’।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তততি কর্মসূচি (সিপিপি)’র বরগুনা সদও উপজেলার সভাপতি জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, বরগুনার মোট জনগোষ্ঠির এক বিরাট অংশ এখনো দূর্যোগ ঝূঁিকতে রয়েছে। বিশেষ করে নদীতীরবর্তি এলাকার বাসিন্দাদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র নির্মান করা হয়নি। সিডরের পর অপরিকল্পিতভাবে কিছু আশ্রয় কেন্দ্র নির্মান হয়েছে। প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনরা ইচ্ছেমত জায়গায় এসব আশ্রয় কেন্দ্র নির্মান করেছেন, অথচ যেসব এলাকায় দরকার সেখানে নির্মিত হয়নি। ফলে এখনো বেশী ঝূঁিকপূর্ণ এলাকার মানুষগুলোর অধিকাংশই ঝড়ের সময় অনিরাপদেই থাকেন।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোঃ মোখলেসুর রহমান বলেন, বরগুনা অত্যন্ত দূর্যোগ ঝূঁিকপূর্ন জেলা। বিভিন্ন সময়ে মারাত্মক সব দূর্যোগে আক্রান্ত হয়েছেন এ এলাকার বাসিন্দারা। ধাপে ধাপে বিভিন্ন এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার নির্মানের কাজ চলছে। আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদীতীরবর্তি ও ঝূঁিকপূণ এলাকার বাসিন্দাদেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কিছু আশ্রয় কেন্দ্র নির্মানের জন্য সরকারে ত্রান ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়ে সুপারিশ পাঠাবো।