ঝালকাঠি প্রতিনিধি
আজ ১৩ নভেম্বর, মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যগাথা ঝালকাঠির চাচৈর রণাঙ্গনের সম্মুখ যুদ্ধের দিন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে চাচৈর বাসীর সম্মুখ যুদ্ধ ইতিহাসে এক নজির হয়ে আছে। ঝালকাঠি সদর উপজেলার নথুল্লাবাদ ইউনিয়নের চাচৈর গ্রামে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকারের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। এ যুদ্ধ ৯নং সেক্টরের অন্যতম বড় যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধারা এখানকার মতো সাফল্য সেক্টরের অন্য কোথাও পাননি। সে যুদ্ধে নিহত শহিদদের স্মরণে ১৯৯১ সালে স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। যুদ্ধের পরে কেটে গেছে ৪৬ টি বছর। এখনও সেভাবেই পড়ে রয়েছে সব। শুরু হয়নি স্মৃতিসৌধের কাজ। অবহেলায় আজও পড়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও গৌরবের স্মৃতিময় চাচৈরের রণাঙ্গন। সেখানে তৈরি হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ, সহায়তা পায়নি কোন শহীদ পরিবার ।
১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝালকাঠি সদর উপজেলার চাচৈর গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান ওমর (বীর উত্তম) এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং আশপাশের অঞ্চলের ক্যাম্প থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে সাঁড়াশি আক্রমণ করে শত্রুদের তছনছ করে দেয়। চাচৈর ছাড়া আশপাশের কয়েকটি গ্রামেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে আবদুল আউয়াল নামে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং পাকবাহিনীসহ তাদের সহযোগী কুখ্যাত রাজাকার বাহিনীর ৮৬ জন নিহত হয়। মুখোমুখি এ লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছিল।
সামনাসামনি এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার জানালেন সেদিনের কথা। ঝালকাঠির সদর উপজেলার চাচৈর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সাব-ক্যাম্প। নলছিটি উপজেলা কমান্ডার মো. সেকান্দার মিয়ার নেতৃত্বে ২৮ জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের এ সাব-ক্যাম্পে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ করবে বলে ১২ নভেম্বর রাতে খবর পাই। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর আমাদের রণকৌশল জানিয়ে দেন। হানাদার বাহিনী ধীরে ধীরে আমাদের ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালাবার জন্য প্রস্তুতি নেই আমরা। সকাল ১০টায় এক প্লাটুন হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে গ্রামে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ৩ দিক থেকে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করি। দক্ষিণ দিক খোলা পেয়ে সেদিকে তারা পিছু হটতে থাকে। এর মধ্যেই অনেক রাজাকার ও পাকিস্তানী হানাদার সেনা মারা পড়ে।
পরদিন পাকবাহিনী আরও শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে চাচৈর , বাড়ৈয়ারা, হরিপাশা, প্রেমহার গ্রামের প্রায় চারশ’ বাড়িঘর আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেলে হানাদার বাহিনী দক্ষিণ দিক খোলা দেখে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। সেখানে ওঁত পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা সুযোগ বুঝে ব্রাশ ফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই ১৮ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ যুদ্ধ। এতে এলাকার বাসিন্দা আদু খান, হামেদ আলী, সেকান্দার মাঝি, আলেয়া ও তার ছোট ভাই শহীদ হন । আলোচিত এই যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয় ঘটে পাকিস্তান বাহিনীর। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সৈনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। নিহতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কারও মতে ৬০ থেকে ৭০ জন, আবার কারও মতে শতাধিক।
মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উদ্দিন বলেন, আমরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যেখানে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে সেখানে কোন স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ তো দূরের কথা কোন পরিকল্পনাও সরকার গ্রহণ করেনি।” মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঝালকাঠি জেলার ডেপুটি কমান্ডার দুলাল সাহা বলেন, ‘‘চাচৈর রণাঙ্গনে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য একটি প্রস্তাব ঝালকাঠি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ হতে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তার কোন ফলাফল এখনও দেখতে পাচ্ছি না’’।