মেহেদী হাসান জসীম, ঝালকাঠি
আইন অমান্য করবেন না -এমন প্রতিজ্ঞা করে জীবনযাপন করেন তিনি। আশপাশের সবাই যখন উৎসব করে আইন ভাঙছে তখন তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন মানুষ। অতি দরিদ্র ও ভূমিহীন এই মানুষটি পেশায় একজন গরিব জেলে।
১ অক্টোবর থেকে মাছ শিকারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় একবারের জন্যেও নদীতে মাছ শিকারে যাননি তিনি। তার নৌকাটিও ডাঙ্গায় তুলে রেখেছেন। সীমাহীন অভাবেও তিনি আইন অমান্য করবেন না এমন প্রতিজ্ঞা তাঁর। পুরো নাম মো. মোদাচ্ছের আলী হাওলাদার। বয়স ৬৫।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বাদুলতলা গ্রামের মৃত তসলিম হাওলাদারের ছেলে মোদাচ্ছের আলী এক মেয়ে ও দুই ছেলের বাবা। বড় ছেলে ঢাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় চাকুরি করে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে কামাল হোসেন বাদুরতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেনির ছাত্র। ছোট ছেলেই এখন তার একমাত্র সম্বল। তাকে সঙ্গে নিয়েই নদীতে মাছ ধরা অথবা দিন মজুরী করাই তাঁর কাজ।
বিষখালী নদীর বাদুরতলা অংশে ইলিশ শিকারের সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে কথা হয় মোদাচ্ছের আলীর সঙ্গে। আইন অমান্য করে সবাই যখন নদীতে মাছ ধরছিলো তখন তিনি সবাইকে আইন মানতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। সময় পেলেই তিনি নদীর পাড়ে এসে বসেন। একদিকে এই বিষখালী নদী তার রোজগারের মাধ্যম অপরদিকে এই নদীতেই বিলীন হয়ে গেছে তাঁর সব সহায়-সম্বল।
স্থানীয় জেলে ইলিয়াস হোসেন বলেন, মোদাচ্ছের চাচাকে কোনোদিনই অবরোধের সময় মাছ ধরতে দেখিনি। তিনি সবাইকে আইন মানতে বলেন। আইন মানা সব নাগরিকের জন্য দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি। সবাই আইন না মানলেও তাকে দেখে কিছু মানুষ উৎসাহিত হয়েছে। অনেকে তাঁর কথায় বিরক্ত হলেও একরোখা প্রকৃতির মোদাচ্ছের চাচাকে এলাকার সবাই ভালোবাসে।
অভাবের সংসার কীভাবে চলে জানতে চাইলে মোদাচ্ছের আলী বলেন, ‘গাঙ্গে সরকার অবরোধ দেওয়ায় মাছ ধরি না। দিন মজুরি কইর্যা যা পাই তাই দিয়া সংসার চালাই। পাঁচদিন কাম করছি, দুই আজার (হাজার) টাকা পাইছি। চাউল আর মোডা ডাইল কিনছি, বাকিটা আল্লা ভরসা।’
এক সময় তাঁর সবকিছুই ছিল। চাষের জমি, হালের গরু, নিজের নৌকা, মাছ ধরার জাল সবই। কিন্তু নিষ্ঠুর বিষখালী নদী তার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। গত চল্লিশ বছরে অন্তত ছয়দফা নদী ভাঙ্গন তাকে নিস্ব করে দিয়েছে। তিনি এখন অন্যের বাড়িতে আশ্রিত ভূমিহীন। শত অভাবেও তিনি নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল থেকেছেন।।
মোদাচ্ছের আলী বলেন,‘ নিজেগো বাড়ি, চাষের জমি, গরু-বাছুর সবই আছিল কিন্ত বিষখালী সব খাইছে। গত চল্লিশ বছরে সাড়ে পাঁচ বিঘা জমি বসত বাড়ি সবই গাঙ্গের প্যাডে (পেটে) গ্যাছে। নিজের বলতে আর কিছু নাই। সরকারি কোন সাহায্য পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যার ঘরে ভাত আছে হে সরকারি চাউল পায়। যাগো নিজের জমি আছে হেরা ভূমিহীনের জমি পায়। যারা আসল জাইল্যা (জেলে) হেরা কার্ড পায় না। মেম্বারের লগে দ্যাহা অইলেই কয় দিমুআনে কিন্তু দেয় না। কিছু না পাইলেও অবরোধে মাছ ধরমু না। মোর রিজিকের মাছ গাঙ্গে আছে। ২২ তারিখের পর ধরমু। সাবাইরে মাছ ধরতে নিষেধ করি কিন্তু ওরা অবরোধের মধ্যেও মাছ ধরে। অনেকে লাখ টাহাও কামাই হরছে কিন্তু মোর হেয়া লাগবে না।’
মাছ ধরার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার আর মাত্র তিনদিন বাকি। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে উপকূলের জেলেদের ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় ২০ কেজি করে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্তের নেওয়া হয়েছে। গত ১৩ অক্টোবর এমন নির্দেশনা দিয়ে জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে সরকার।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন সূত্র জানাচ্ছে, বরাদ্দের এসব চাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মাধ্যমে জেলেদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজাপুর উপজেলা মৎস কর্মকর্তা মুক্তারানী সরকার বলেন, রাজাপুর উপজেলায় এক হাজার ১৪৭ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। বছরে তারা চার মাস সরকারি চাল পায়। বর্তমানে মাছ ধরার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার জন্য সরকার অতিরিক্ত চাল বরাদ্দ করেছে। জেলেরা শিগগিরই সেই চাল পাবে।
জানতে চাইলে মঠবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল সিকদার বলেন, ইতিমধ্যেই আমরা সরকারি চাল পেয়েছি। আগামি দিন থেকেই চাল দেয়া শুরু হবে। মোদাচ্ছের আলীর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন একজন আইন মান্যকারি ভাল মানুষ সরকারি সাহায্য পাবে না তা হয় না। আমি অবশ্যই ওই এলাকার ইউপি সদস্যের সাথে এ বিষয়ে কথা বলব এবং তার জন্য সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করব।