মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬
Spread the love

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলার মানুষের গর্ব। লাখ লাখ মা বোন ভাই দের জীবন আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি প্রানের স্বাধীনতা। বাংলার বীর সেনানিদের গৌরবগাঁথা বাংলার ইতিহাস তো বটেই প্রতিটি মানুষের হৃদয়েও সমুজ্জ্বল। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বাঙালিদের পাশাপাশি কিছু মানুষ ছিলেন যারা এই দেশের না হয়েও মানবতার টানে এই গৌরবময় জয়ে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। আজ এই বিদেশীদের কির্তিগাথা নিয়ে কিছু কথা।

ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ডঃ

ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড (জন্ম:৬ই ডিসেম্বর, ১৯১৭ – মৃত্যু:১৮ই মে, ২০০১) একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সমরে বীরোচিত অংশগ্রহণের জন্য বীরপ্রতীক সম্মান লাভ করেন। তিনি খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত্রে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানীদের গণহত্যার অভিযান শুরু করে। অবিলম্বে বাঙ্গালীরাও প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙ্গালীদের এই প্রতিরোধ সংগ্রামে “ওডারল্যান্ড” সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং এমনকি পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধেও অংশ নেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রতি অপরিমেয় ভালবাসার জন্য বাঙ্গালীজাতির কাছে তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য নৈপুণ্যতার কারণে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরপ্রতীক সম্মাননায় ভূষিত করেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কাজ করে অবসর নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত যান বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড, বীর প্রতীক। একমাত্র বিদেশি হিসেবে তাঁকে বাংলাদেশ সরকার এই খেতাবে ভূষিত করেছে। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত অত্যন্ত গর্ব ভরে ও শ্রদ্ধার্ঘ্য চিত্তে নামের সঙ্গে বীর প্রতীক খেতাবটি লিখেছিলেন তিনি। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পার্থের এক হাসপাতালে ২০০১ সালের ১৮ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এডওয়ার্ড কেনেডিঃ

১৯৭১ এ বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় রিপাবলিকান পার্টি। আর তাদের সমর্থন ছিল পাকিস্তানের দিকে। এর মধ্যেই বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সিনেটর এডওয়ার্ড।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে এনেছিলেন এডওয়ার্ড কেনেডি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে মর্মস্পর্শী একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিলেন তিনি।

“বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও এ দেশের মানুষের প্রতি মমতা ও ভালবাসা এভাবেই প্রকাশ করে গেছেন তিনি। এটা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।”

অ্যান্থনি মাস্কারেনহাসঃ

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস (১৯২৮ – জিসেম্বর ৬, ১৯৮৬) জন্মসূত্রে ভারতীয় গোয়ানীজ খ্রিস্টান এবং বসবাস সূত্রে পাকিস্তানী। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুকাল এদেশে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।অ্যান্থনি মাসকারেনহাস (১৯২৮ – জিসেম্বর ৬, ১৯৮৬) জন্মসূত্রে ভারতীয় গোয়ানীজ খ্রিস্টান এবং বসবাস সূত্রে পাকিস্তানী। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুকাল এদেশে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।করাচী থেকে প্রকাশিত দ্য মর্নিং নিউজ-এর প্রধান সংবাদদাতা এবং পরবর্তীতে সহ-সম্পাদক পদে কর্মরত ছিলেন ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সনের মে মাস পর্যন্ত। একাত্তর সনের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে এসে গণহত্যার তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। এরপর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের সানডে টাইম্‌স পত্রিকায় গণহত্যার তথ্যাদি প্রকাশ করেন। এজন্য তিনি স্বয়ং ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। পত্রিকাটির ১৯৭১ সনের জুন ১৩ সংখ্যায় এ সকল তথ্যাদি প্রকাশিত হয়। এতে বিশ্ব বিবেক অনেকাংশেই জাগ্রত হয় এবং বিশ্ববাসী বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে পারে। তিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলী অন্তরঙ্গ আলোকে প্রত্যক্ষ করে সংবাদিকসুলভ ভঙ্গিতে তা বর্ণনা করেছেন। তার লেখা বই হচ্ছে “দা রেইপ অব বাংলাদেশ” এবং “বাংলাদেশের রক্তের ঋণ”।

তার দ্য রেইপ অফ বাংলাদেশ গ্রন্থটি ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়। বইটির সেই প্রাথমিক সংস্করণে শেষ পংক্তিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল সম্বন্ধে আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন:

আমরা সবেমাত্র একটি নতুন অন্ধকারের রাজ্যে প্রবেশ করেছি। অন্ধকারময় সুড়ঙ্গপথের শেষ প্রান্তে যেখানে আলোর রাজ্য শুরু, সেখানে পৌঁছতে আমাদের দীর্ঘ সময় লাগবে।

অবশ্য খুব বেশী সময় আর লাগেনি।

 

 

সায়মন ড্রিংঃ

সাইমন ড্রিং (জন্মঃ ১১ জানুয়ারি, ১৯৪৫) একজন আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী বৈদেশিক সংবাদদাতা, টেলিভিশন উপস্থাপক এবং প্রতিবেদন নির্মাতা। তিনি বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের বৈদেশিক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের অনেক জায়গা ভ্রমণ করে তরতাজা ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পরিবেশনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। এছাড়াও তিনি লন্ডনভিত্তিক দ্য ডেইলী টেলিগ্রাফ, বিবিসি টেলিভিশন এবং রেডিও সংবাদ ও চলতি ঘটনা তুলে ধরার লক্ষ্যে অনবরত কাজ করছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জঘন্য ও নৃশংসতার বিবরণ দৈনিকে তুলে ধরে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সুনাম এনে দেয়। সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশী সাংবাদিক যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরী করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানী বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা।

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভরা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাতে সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরবর্তীতে – হোটেল শেরাটন, বর্তমানে – হোটেল রূপসী বাংলা) লুকিয়ে ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানে সামরিক আইনের তোয়াক্কা না করে ২৭ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে প্রেরণ করেন যা ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান শিরোনামে ৩০ মার্চ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে তাঁর এ প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। উক্ত প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে,

আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরের…।

১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে পুণরায় নভেম্বর, ১৯৭১ সালে কলকাতায় আসেন তিনি। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় খবরাখবর নিরপেক্ষভাবে ঐ দৈনিকে প্রেরণ করতেন। ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে বিজয়ের দিনে যৌথবাহিনীর সাথে তিনিও ঢাকায় এসেছিলেন।

সিডনি শ্যানবার্গঃ

সিডনি শ্যানবার্গ ছিলেন দি নিউইয়র্ক টাইমস এর একজন সাংবাদিক। তিনি ১৯৩৪ সালের ১৭ই জানুয়ারী আমেরিকার ক্লিনটন মাসাচুয়েটস এ জন্মগ্রহন করেন ।১৯৫৯ সালে তিনি দি নিউইয়র্ক টাইমস এ যোগদেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চএর হত্যাকান্ড তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন। সে সময় তিনি ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। হোটেলের জানালা দিয়ে তিনি দেখেন ইতিহাসের এক ভয়ানক হত্যাকান্ড । তিনি পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের উপর অসংখ্য খন্ড খন্ড প্রতিবেদন পাঠান যার অধিকাংশ ছিল শরণার্থী বিষয়ক। তার প্রতিবেদনে পুরো বিশ্ব জানতে পারে পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থী দের অবস্থা ।তার অসংখ্য প্রতিবেদনের একটি নির্ববাচিত সংকলন প্রকাশ করেছে ঢাকার সাহিত্য প্রকাশ ।সংকলনটির নাম ডেটলাইন বাংলাদেশ-নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান। অনুবাদ ও সংকলন করেছেন মফিদুল হক ।

 

 

জে এফ আর জ্যাকবঃ

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুদের মধ্যে ভারতের লে. জেনারেল (অব.) জে এফ আর জ্যাকব হচ্ছেন বাংলাদেশের অনেক বড় একজন বন্ধু। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্যে আমাদের বিজয় হয়েছিল তরান্বিত। একাত্তরে তিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ, তখন তার পদমর্যাদা ছিল মেজর জেনারেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান ছিল অনস্বীকার্য আর এক্ষেত্রে জেনারেল জ্যাকবের বিশাল ভূমিকা ছিল। সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পগুলোর পুনর্গঠন, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, অস্ত্র-রসদ জোগান দেয়াসহ মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথ অভিযানে এসে বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত জয়ে অসামান্য অবদান রাখে ভারতীয় বাহিনী। সর্বোপরি তার ভাষ্য থেকে জানা যায় ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১এ জেনারেল নিয়াজীকে লজ্জাজনক এবং নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলেন তিনি।

রবি শংকর –জর্জ হ্যারিসন –কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

একসাথে রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসন

দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ হলো ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন প্রাঙ্গনে দ্য বিটল্‌স ব্যান্ডের জর্জ হ্যারিসন ও ভারতীয় সেতারবাদক পন্ডিত রবি শংকর কর্তৃক আয়োজিত দুটি দাতব্য সঙ্গীতানুষ্ঠান। এই সঙ্গীতানুষ্ঠান দুটি আয়োজিত হয় ১ আগস্ট ১৯৭১ সালে। এই অনুষ্ঠানে বিশ্ববিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের এক বিশাল দল অংশ নিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, জর্জ হ্যারিসন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ব্যাড ফিঙ্গার এবং রিঙ্গো রকস্টার ছিলেন উল্লেখযোগ্য।

এই কনসার্টের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) বাংলাভাষী জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদারদের সীমাহীন অত্যাচার-নিপীড়নের কথা জানতে পারে সারা বিশ্ব! এই কনসার্টের হাত ধরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ দাঁড়িয়ে যায় বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে! এ কনসার্টের মাধ্যমে পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন স্বাধীনচেতা বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে। এই কনসার্টের কারণে বিশ্বের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও দুর্বল হতে খাকে চেঙ্গিসীয় পাকিস্তানিরা।

এই অনুষ্ঠানের গানের একটি সংকলন কিছুদিন পরেই ১৯৭১ সালে বের হয় এবং ১৯৭২ সালে এই অনুষ্ঠানের চলচ্চিত্রও বের হয়। গত ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে উক্ত চলচ্চিত্রটিকে একটি তথ্যচিত্রসহ নতুনভাবে ডিভিডি আকারে তৈরি করা হয়।

কনসার্ট ও অন্যান্য অনুসঙ্গ হতে প্রাপ্ত অর্থ সাহায্যের পরিমাণ ছিলো প্রায় ২,৪৩,৪১৮.৫১ মার্কিন ডলার, যা ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ব্যয়ীত হয়।

কমপক্ষে পঁচিশ হাজার মার্কিন ডলার সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করলেও সেই কনসার্ট থেকে অবিশ্বাস্যভাবে প্রায় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার তহবিল সংগৃহীত হয়। এই কনসার্টের সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা ইউনিসেফ অর্জিত অর্থ বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করে।

আন্দ্রে মালরোঃ

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই মালরো একাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ফ্রান্সে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তার বক্তৃতা-বিবৃতি আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক প্রেরণা হয়ে উজ্জীবিত করেছিল সে সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের। ফ্রান্স সরকারের উদ্দেশে তার করা আকুতি :

‘আমাকে একটি যুদ্ধবিমান দাও, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনের শেষ লড়াইটা করতে চাই”

বাল্টিমোর বন্দর শ্রমিকঃ

বাল্টিমোর আমেরিকার অঙ্গরাজ্য মেরিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর । এখানে বাল্টিমোর সমূদ্রবন্দর নামে একটি সমূদ্রবন্দর রয়েছে । এই সমূদ্রবন্দরে প্রতিদিন অনেক বড় বড় জাহাজ ভিড় করে। এসব জাহাজে পণ্য উঠানো নামানোর কাজ করে অনেক শ্রমিকের সংসার চলে । কোনও দিন বন্দর বন্ধ থাকলে বা শ্রমিক অশোন্তোষ দেখা দিলে এদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এতও প্রতিকূলতার পরও ১৯৭১ সালের ১৪ই জুলাই ঐ বন্দরের একদল শ্রমিক ও স্থানীয় কিছু আমেরিকান পশ্চিম পাকিস্তানের পদ্মা নামের একটি যুদ্ধ জাহাজে অস্ত্র তুলতে বাধা প্রদান করে। শুধু তাই নয় তারা অনেকগুলো ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে বাধ তৈরী করে ঐ জাহাজের গতিপথ আটকে দিয়েছিল। এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেদিন অনেকে গ্রেফতার হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে জাহাজটি ছিল কয়েক হাজার টন ওজনের ।এই জাহাজ চলার সময় যে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় তাতে অনেক বড়ও বড়ও নৌকা ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।জাহাজের প্রপেলারের আঘাতে যে কেউ কেটে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে । বাল্টিমোরের জনগনের সেদিনের প্রতিবাদের ফলে জাহাজটি বন্দর থেকে কোনও অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি নিতে পারেনি । স্থানীয়দের বাংলার মানুষের প্রতি এই সহানুভূতির ফলে সেদিন পুরো আমেরিকা এবং বিশ্বের অনেক দেশের জনগণ বাংলাদেশে সংগঠিত পাক বাহিনীর হত্যাকান্ডের কথা জানতে পারে।

ইন্দিরা গান্ধীঃ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব বিদেশি বন্ধুকে আমরা পেয়েছি তাদের মধ্যে অন্যতম ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি শুধু এক কোটি বাংলাদেশিকে আশ্রয় ও খাওয়া-পরার ব্যবস্থাই করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। আর বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি মার্কিন রক্তচক্ষুর বিপরীতে এক অনন্য অবস্থানও নেন তিনি।

বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য ভারতের বিরুদ্ধেও পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করলে সেখানেও এক হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধের নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে সেবাযত্ন করায় ইন্দিরা গান্ধীর এ কাজকে যিশু খ্রিস্টের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা।

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সম্মাননা জানিয়েছে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর। ১৯৭১ এ ভারতের সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেন। তাদের থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য সাহায্য করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী হিসেবে প্রতিবাদী অথচ নিরস্ত্র বাঙালিকে সাহস জোগান তিনি। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, যুবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় ভারতে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে সশস্ত্র অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে একের পর এক গেরিলা যুদ্ধে পরাস্ত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে।

মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়েই, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘পূর্ববাংলায় যা ঘটেছে, তাতে ভারত সরকার নীরব থাকবে না।’ পরে ১৭ মে তিনি পশ্চিমবঙ্গ আসেন। কারণ সেখানেই সবচেয়ে বেশি শরণার্থী আশ্রয় নেয়। ৩০ এপ্রিল ’৭১ ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেন। ৯ মে তাদের হাতে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে আগ্রহী বাংলাদেশের তরুণদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়ার দায়িত্ব।

এ ছাড়া শাসক পাকিস্তানিদের বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন আদায়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সে সময় বিভিন্ন দেশ সফরও করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের জন্য একটি ট্রান্সমিটার বরাদ্দ করেন ইন্দিরা গান্ধী। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং সামরিক সাহায্য বন্ধের বিষয়ে অক্ষমতা জানালে ইন্দিরা গান্ধী তাকে বলেন, ‘ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহয়তা বাড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই