একটি প্রজন্ম ধ্বংস করে দিতে পারে স্মার্টফোন?

একটি প্রজন্ম ধ্বংসের পেছনে স্মার্টফোন?
Spread the love

আয়না ২৪  ডেস্ক

মানুষের মধ্যে ত্বরিত যোগাযোগের প্রতিশ্রুতির নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তবে অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে এটি এখন ভিন্ন কিছু। এর কারণে তরুণদের মধ্যে বাড়ছে একাকিত্ব। আইফোনে আসক্ত তরুণ এ প্রজন্মকে বলা হচ্ছে ‘আইজেন’।

দ্য আটলান্টিকের এক প্রতিবেদনে এ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্মার্টফোনের প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে।ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনকার কিশোরেরা বন্ধুর সান্নিধ্যে কম সময় কাটায়, তাদের মধ্যে ডেটিং কমছে, এমনকি পুরো প্রজন্মের ঘুম কম হচ্ছে। একাকিত্বের এই হার বাড়ায় সাইবার নিপীড়ন, হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে।

‘হ্যাভ স্মার্টফোনস ডেস্ট্রয়েড আ জেনারেশন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে আইজেন প্রজন্মের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার অধ্যাপক জিন টুয়েঙ্গে।

প্রজন্মের সঙ্গে প্রজন্মের ফারাক সহজেই চোখে পড়ে। আশির দশকের এক তরুণের পক্ষে বাবা-মাকে বাদ দিয়ে শুধু বন্ধুদের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা শপিং মলে ঘুরতে পারা ছিল কল্পনার বিষয়। এখনকার পাশ্চাত্য কিশোর-কিশোরীরা বন্ধুর সঙ্গে শপিং মলে ঘুরে বেড়ায় স্বচ্ছন্দেই। বাবা-মায়ের সঙ্গেও যদি যায়, তবে ফোন-ট্যাব নিয়ে এতটাই দূরত্ব রাখে যেন ওই যন্ত্রের মধ্যেই আটকে আছে সে। প্রতি মুহূর্তেই চোখ রাখতে হয় পর্দায়। অ্যাথেনা বন্ধুদের সঙ্গে স্মার্টফোনেই সময় কাটায় বেশি। স্ন্যাপচ্যাটে বার্তা দেওয়া-নেওয়া চলতে থাকে। কিন্তু আশির দশকের এক তরুণের কথা চিন্তা করুন, বাসার একমাত্র ল্যান্ডফোনে বন্ধুর সঙ্গে একটু গল্প করার জন্য তাদের কত অপেক্ষায় থাকতে হতো!

২০১২ সাল থেকে তরুণদের আচরণ ও মানসিক অবস্থার হঠাৎ পরিবর্তন চোখে পড়তে শুরু করে। তাদের মধ্যে মিলেনিয়াল প্রজন্মের যে বৈশিষ্ট্য তা উধাও। গবেষক নিল হাউ ও উইলিয়াম স্ট্রাউস মিলেনিয়াল প্রজন্ম কথাটা প্রথম ব্যবহার করেন। ১৯৮২ থেকে ২০০৪ সাল সময়ের মধ্যে জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে বলা হয় মিলেনিয়াল প্রজন্ম। একটি গবেষণা অনুযায়ী, মিলেনিয়াল প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডিজিটাল জ্ঞান। তবে এর সঙ্গে মানবিক গুণাবলি অর্জনেও যত্নশীল এই প্রজন্ম।

২০১২ সালে কী ঘটেছিল, যাতে আচরণে এত ব্যাপক পার্থক্য ঘটে গেল? ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দা মিলেনিয়াল প্রজন্মের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তারা আর্থিকভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

১৯৯৫ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্য যাদের জন্ম, তাদের ‘আইজেন’ বলা যায়। এ প্রজন্মকে স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম সম্বল করে বেড়ে উঠেছে। তাদের আচরণ ও আবেগের ধরন আগের চেয়ে আলাদা। হাইস্কুলে যাওয়ার আগেই ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়েছে কিন্তু ইন্টারনেটের আগের কোনো সময় সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই তাদের নেই। মিলেনিয়ালরাও অবশ্য ইন্টারনেটের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের জীবন এর বাইরেও ছিল। অধ্যাপক টুয়েঙ্গে মনে করেন, ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত কোনো প্রজন্মের সঙ্গেই এদের মিল নেই। ২০০৭ সালে আইফোন যখন প্রথম বাজারে আসে, তখন আইজেন প্রজন্ম একেবারেই শিশু ছিল।

একটি প্রজন্ম ধ্বংসের পেছনে স্মার্টফোন?

একই ছাদের নিচে মা-বাবার সঙ্গে থেকেও মা-বাবার কাছ থেকে আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেকটাই দূরে আইজেনরা। মা-বাবার সঙ্গে এখনকার তরুণেরা কথা বলে কম। তাদের বলতে শোনা যায়, ‘ওকে’, ‘ঠিক আছে’ জাতীয় সংক্ষিপ্ত উত্তর। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময়ে তাদের ফোনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। পরিবারের সদস্যদের দিকে মন থাকে কম। তারা বিছানায় শুয়ে-বসে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে। আশপাশে তাকানোর সময় নেই। তাদের কাছে বিছানা যেন শরীরের একটি অংশ। বেশির ভাগ সময় কোথায় তারা থাকতে চায়? তাদের ঘরে, মোবাইল বা ট্যাবের স্ক্রিনের দিকে তাকানো এবং প্রায়শই বিষাদগ্রস্ত অবস্থায়।

এমনকি এ নিয়ে তাদের মধ্যেও ফোন নিয়ে বিরক্তি দেখা যায়। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে গেলে উত্তর আসে না, বন্ধুটি হয়তো তখন ফোন নিয়ে ব্যস্ত। বাবা-মাদের কেউ কেউ থাকেন ফেসবুক আসক্ত। কথা বলতে গেলে মুখের দিকে তাকান না, উত্তর দেন ফোনের দিকে তাকিয়ে।

সামাজিক মাধ্যম, মানে ফেসবুক, স্ন্যাপচ্যাট, টুইটার—এসব তাৎক্ষণিক যোগাযোগের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু একের পর এক প্রমাণ দেখাচ্ছে, অনেক কিশোর-কিশোরীর জন্য যত বেশি সামাজিক মাধ্যম, মানে তত বেশি বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি। মানসিকভাবে তারা মিলেনিয়াল প্রজন্মের চেয়ে বেশি নাজুক মনোভাবের পরিচয় দেয়। ২০১১ থেকে আইজেনের মধ্যে আত্মহত্যা ও অবসাদের মাত্রা ধাঁই ধাঁই করে বাড়ছে।

স্মার্টফোনের এ আসক্তি কাটাতে লেখকের পরামর্শ হচ্ছে, তরুণদের যতটা সম্ভব স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখতে হবে। তা না হলে তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। যদি তরুণদের হাতে যোগাযোগের জন্য মুঠোফোন দিতে হয়, তা ফিচার ফোন হলে ভালো। স্মার্টফোন দিলেও তা কতক্ষণ কোন অ্যাপ ব্যবহার করবে, তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। রাতে তারা যাতে ঠিকমতো ঘুমায়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। কিশোর বয়সীরা যাতে দিনে কোনোভাবেই এক থেকে দেড় ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোন না ব্যবহার করে, সেদিকে অভিভাবকের খেয়াল রাখা উচিত।

দ্য আটলান্টিক অবলম্বনে  আল-মাসুদ নয়ন