
অায়না২৪ ডেস্ক
সৌদি আরবের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেল রিজ-কার্লটন। সৌদির রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সঙ্গে রাজধানী রিয়াদের এই হোটেলেই শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন দেশটির বাদশাহ ও যুবরাজেরা। এখন এই তারকা হোটেল ‘বিলাসবহুল কারাগার’।
সেখানে দুই শতাধিক রাজকীয় বন্দীকে আটক রাখা হয়েছে। এরমধ্যে অন্তত ১১ জন প্রিন্সও রয়েছেন যাঁরা সৌদি আরবের ধনকুবের হিসেবে পরিচিত। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এই হোটেলে প্রবেশ ও বের হওয়া নিষিদ্ধ।
সৌদি আরব তো বটেই পুরো বিশ্বে এই হোটেলে ভেতরে কি হচ্ছে এনিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। রিজ-কার্লটনের ভেতরে আসলে কী হচ্ছে? কীভাবে রাখা হয়েছে বন্দীদের? এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে তেমন কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি। কারণ, সৌদি সরকার এ ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখছে এই বিষয়টি।
তবে সম্প্রতি রিজ-কার্লটনে ঢোকার অনুমতি পান বিবিসির প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি লাইজ ডুসে। বিশেষ প্রহরায় তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। হোটেলের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ঢোকার অনুমতি ছিল তাঁর। কথাও বলেছেন নির্ধারিত কিছু ব্যক্তির সঙ্গে। অন্তত ‘পাঁচ তারকা কারাগারের’ অন্দরমহলের আংশিক চিত্র দেখতে পেরেছেন লাইজ। তবে আটক ব্যক্তিদের ছবি বা ভিডিও চিত্র তুলতে পারেনি বিবিসি।
দুই শতাধিক বন্দীকে রাখা হয়েছে রিজ-কার্লটনে। এঁদের মধ্যে কমপক্ষে ১১ জন প্রিন্সও আছেন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যেবিবিসি গত সপ্তাহে রিজ-কার্লটনে ঢোকার অনুমতি পায়। মধ্যরাতে লাইজ ডুসেকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা এই পাঁচ তারকা কারাগারে থাকার সুযোগ পান তিনি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে লাইজ লিখেছেন, কারাগারে পরিণত হলেও রিজ-কার্লটনে বিলাসিতার কমতি নেই। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার মধ্যেই বন্দী রয়েছেন ধনকুবের বন্দীরা।
চলতি মাসের শুরুতে সৌদি রাজপরিবারে গ্রেপ্তার অভিযান চালান বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। দুর্নীতির অভিযোগে প্রিন্স আলওয়ালিদ বিন তালালসহ ১১ জন প্রিন্স ও চারজন মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বরখাস্ত করা হয় নৌবাহিনীর প্রধানকে। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীও গ্রেপ্তার হন। প্রথম থেকেই তাঁদের ঠিকানা হয় বিলাসবহুল রিজ-কার্লটন। এরই মধ্যে এই হোটেলে থাকা বন্দীদের কম্বল মুড়িয়ে মেঝেতে ঘুমানোর ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
তবে বিবিসির প্রতিনিধি সেখানে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখতে পাননি। নির্ধারিত ব্যক্তিদের বাইরে আরও কয়েকজনের দেখা পান লাইজ ডুসে। তাঁরা একান্তে বসে চা খাচ্ছিলেন। কদাচিৎ তাকাচ্ছিলেন ইতি-উতি। কথাও বলছিলেন খুব নিচু স্বরে।
দুর্নীতির অভিযোগে আটক এক সন্দেহভাজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান লাইজ। তাঁর নাম জানা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ সময় আমি আমার হোটেল কক্ষেই থাকি। আমার আইনজীবীর সঙ্গে মিলে মামলার বিষয়গুলো দেখি। প্রতিদিনই পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ পাই আমি। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের এখানে আসতে মানা করেছি।’
ওই ব্যক্তির সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলা যায়নি। পুরোটা সময়ই বিবিসির প্রতিনিধিদের ঘিরে রেখেছিলেন দুর্নীতি দমনে গঠিত বিশেষ কমিটির পদস্থ লোকজন। চলে আসার সময় লাইজ ডুসেকে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি দুঃখিত যে নিজেদের ঐতিহ্য অনুযায়ী আপনাকে আপ্যায়িত করার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমার অবশ্যই আপনাদের আপ্যায়নের অনুরোধ করা উচিত ছিল।’
বিলাসবহুল হোটেলে থাকলেও নিজেদের মামলা নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন আটক ব্যক্তিরা। বেশির ভাগ সময় হোটেল কক্ষেই থাকছেন তাঁরা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যেবেশির ভাগ আটক ব্যক্তিই এভাবে নিজেদের হোটেল কক্ষেই দিন কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে। অন্যদের সঙ্গে বেশি কথাও বলছেন না তাঁরা। মূলত এই বিলাসবহুল কারাগার থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছেন তাঁরা। এটিই এখন আটক ব্যক্তিদের প্রধান লক্ষ্য। বলা হচ্ছে, দুর্নীতির অভিযোগ থাকা অধিকাংশ সন্দেহভাজন ব্যক্তিই সমঝোতার মাধ্যমে সরকারের কোষাগারে অর্থ ফেরত দিতে সম্মত হয়েছেন। সৌদি সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে, আটক ব্যক্তিদের ৯৫ শতাংশই সমঝোতায় আসতে চান। আর ৪ শতাংশ ব্যক্তি মামলা আদালতে নিতে চান।
গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, রিজ-কার্লটনে আটক ব্যক্তিদের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার এবং এখনো পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৯০০ ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমনবিষয়ক বিশেষ কমিটির এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমরা যদি ১০০ বিলিয়ন ডলারও ফেরত পাই, তাতেও ক্ষতি কী?’
সৌদি আরবে গঠন করা দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষের আরেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ’ করা হচ্ছে। তবে গুজব ছড়িয়েছে, রিজ-কার্লটনে আটক ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে এবং সেখানে সঠিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে না। একজন মানবাধিকারকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেন, ‘কয়েকজন বেশ বয়স্ক। কেউ কেউ ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।’ তিনি আরও জানান, যেহেতু ওই হোটেলে কথিত দুর্নীতির অর্থ ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, সুতরাং আটক ব্যক্তিদের উত্তেজনা, উদ্বেগ ও উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভোগার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। তবে খবর রটেছে, প্রায়ই নাকি হোটেলে হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞদের ডেকে নিতে হচ্ছে।
তাহলে কি পাঁচ তারকা কারাগারের ভিআইপি বন্দীরা বহাল তবিয়তেই আছেন? সৌদি সরকারের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, বন্দীদের ক্ষেত্রে জীবনযাপন-সংশ্লিষ্ট কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এমনিতে রিজ-কার্লটনে সুযোগ-সুবিধার শেষ নেই। তবে ভিআইপি বন্দীদের সব ধরনের বিলাসিতা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই নাম প্রকাশে অপারগতা জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো বিশেষ দেশের বিশেষ খাবার তাঁদের দিতে পারছি না। একজন যেমন আমার কাছে রাশিয়ার ক্যাভিয়ার (সামুদ্রিক মাছের ডিম) চেয়েছিলেন। আরেকজন আবার ব্যক্তিগত নাপিতকে ডেকে দিতে বলেছিলেন, একজন চেয়েছিলেন শরীর ম্যাসাজ করার নিজস্ব লোক। কিন্তু কঠোর নিয়মকানুনের কারণেই তা সম্ভব হচ্ছে না।’
প্রাথমিকভাবে আটক করার পরপরই সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। এখন হোটেলের ফোন দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন তাঁরা। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে আইনজীবীদের ফোন দেওয়া হচ্ছে।
তবে বিলাসবহুল কারাগার বেশি দিন চালানো হবে না বলে জানিয়েছেন দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন তদন্তকারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘শোনা যাচ্ছে, যুবরাজ শিগগিরই এই অধ্যায় শেষ করতে চাইছেন। যদি এটি বেশি দিন ধরে চলতে থাকে, তবে তা নিয়ে আরও অনেক প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।’