আয়না২৪ ডেস্ক
সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল’ ঘিরে অভিযান চলাকালে শনিবার সন্ধ্যা ও রাতে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয়জনে। এর মধ্যে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। বাকি চারজন বেসামরিক নাগরিক।
শনিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন জানান, ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম মারা গেছেন। তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন।
এ ছাড়া ওই ঘটনায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ছাত্রলীগের উপ পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক জান্নাতুল ফাহিম নিহত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাশেদুল ইসলাম।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকায় জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল’ ঘিরে গুলি-বিস্ফোরণের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। সেনা কমান্ডোদের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান গতকাল শনিবার দ্বিতীয় দিনের মতো চলে। অভিযানে সেনাবাহিনী, সোয়াত, পুলিশ, র্যাব সদস্যরা অংশ নিচ্ছে।৭৮ জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যার পর ঘটনাস্থলের পাশেই জঙ্গিরা দুদফা হামলা চালিয়েছে। এতে একজন পুলিশসহ ৩ জন নিহত হয়েছেন। প্রথম হামলায় মোটরসাইকেল আরোহীর ঘটানো বিস্ফোরণে দুইজন নিহত হয়েছেন। দ্বিতীয় দফা হামলায় আরো দুইজন নিহত হন । দুটি হামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকসহ অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
গতকাল শনিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) আকতারুজ্জামান বসুনিয়া এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, নিহতদের একজনের নাম আবু কাউসার। তিনি সিটি এসবির পরিদর্শক। নিহত আরেকজনের পরিচয় জানা গেছে, তিনি কলেজছাত্র অহিদুল ইসলাম অপু। অপরজনের পরিচয় নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এবং পুলিশ ও সোয়াতের সহায়তায় চলা ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নিয়ে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ব্রিফিং করা হয়। ব্রিফিং শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে ব্রিফিংস্থলের কাছে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় সাংবাদিকসহ ৩০ জনের বেশি আহত হন। এরপর রাত সাতটা ৫৫ মিনিটের দিকে আগের ঘটনাস্থলের কাছে পূর্ব পাঠানতলা মসজিদ এলাকায় আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ হয়। পুলিশসহ ৪২ জনকে সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, একটি মোটরসাইকেলে করে দু’জন এসে বিস্ফোরণ ঘটালে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রুকনুদ্দিন বলেন, লাশগুলো সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে।
ঘটনার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে পৌঁছে অবিস্ফোরিত একটি বোমা ও মোটর সাইকেল উদ্ধার করেছে। এর আগে ব্রিফিংয়ে গত দুদিন থেকে বহুল আলোচিত সিলেটের শিববাড়িতে অপারেশন অব্যাহত রয়েছে বলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় অভিযানে অংশ নেওয়া সেনা সদস্যদের পক্ষ থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল হাসান সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন।
এর আগে গত শুক্রবার ভোর ৩ টায় আতিয়া মহলকে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে রাখে কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিটের সদস্যরা। পরে এসে যোগ দেয় সোয়াত ও সেনাবাহিনীর কমান্ডো সদস্যরা। তবে ভেতরে কতজন জঙ্গি অবস্থান করছে সে ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি। তারা জীবিত না মারা গেছে এমন তথ্যও বলেননি অভিযানকারীরা।
গতকাল শনিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত সাড়ে ৩৮ ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত অভিযান চলছিল। অভিযান কালে দফায় দফায় প্রচন্ড গুলি ও বিষ্ফোরণের শব্দে এলাকা প্রকম্পিত হয়। বিকাল ৪টা ৫৬ মিনিট থেকে পর পর ৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর দু’জন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সদস্য আহত অবস্থায় বের হয়ে আসছেন বলে জানায় স্থানীয়সূত্র। এর আগে বেলা ৩টায় গোলাগুলির সময় এলাকার বসিন্দা শিপলু নামের একজন আহত হয়ে ওসমানীতে ভর্তি হয়েছেন। সকালেও গুলি হয়েছে। এলাকাবাসী জানান, তারা আতংকের মধ্যে সময় পার করছেন। ঘটনাস্থলে মিডিয়া কর্মীদেরও যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সেখানের সঠিক চিত্র জানা যাচ্ছে না। কর্মকর্তারা নিজ নিজ দায়িত্বে ব্যস্ত। তারাও কিছু বলছেন না।
শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এই জঙ্গি অভিযানের দ্বিতীয় দিন গতকাল সকাল থেকে ৮ ঘন্টার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি যেন আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বেলা সোয়া ৩ টার দিকে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে মোড় নেয়। মুহুর্মুহু গুলি ও পরে বিস্ফোরণের শব্ধে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠে। ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক। চুড়ান্ত অভিযানের আগে বেলা সোয়া ২ টার দিকে আতিয়া মহল এর দুটি ভবন থেকে সর্বশেষ ৩ জন গর্ভবতী মহিলাসহ ৭৮ জন বাসিন্দাকে সেখান থেকে নিরাপদে নিয়ে আসা হয়। পরে কমান্ডোরা চূড়ান্ত আঘাত হানে।
সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের লে. কর্নেল ইমরুল কায়েস এই অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সার্বিক তত্বাবদানে রয়েছেন এই ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনোয়ারুল মোমেন। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামও সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তরাও ঘটনাস্থলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আতিয়া মহলের মালিক উস্তার আলী গতকাল বিকালে জানান, সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে দুপুরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়িতে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার কর্যক্রমে সহায়তা করতে। তখন জানালা দিয়ে জঙ্গিরা গ্রেনেড ছুড়ে এবং বিকট শব্ধ হয়। এর আগে বার বার ‘আতিয়া মহল’ এর ভিতরে অবস্থানরত জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের জন্য বলা হয়; কিন্তু তারা তা গ্রাহ্য করেনি।
এদিকে গতকাল সকাল থেকেই ওই এলাকার সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক বন্ধ করে দিয়ে ঘটনা স্থল থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সরিয়ে দেয়া হয় উপস্থিত লোকজনদের। আশপাশের বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়। গতকাল সকাল ৮টার দিকে সেনা কমান্ডোরা সেখানকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সকাল সোয় ৯ টায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা মূল ভবনের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের জন্য সেনাবাহিনীর চারটি বুলেট প্রুফ আর্মার ভেহিক্যাল সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ রোডের শিববাড়ি রাস্তার মুখে এগুলো অবস্থান নেয়। সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো ইউনিটের সদস্যদের সাথে সোয়াতও আছে।
সূত্র জানায়, অপরেশন ‘টোয়াইলাইট’-এর প্রথম লক্ষ্য জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আভিযানের আগে আতিয়া মহল-১ ও আতিয়া মহল-২ দুটি ভবনে আটকে থাকা অবশিষ্টদের নিরাপদে উদ্ধার করে নিয়ে আসা। কিন্তু উদ্ধারে নামার পর পর শুরু হয়ে যায় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। সেই সঙ্গে বজ্রপাত। এতে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তবে এরাই মধ্যে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ভবনে আটকে থাকাদের সম্পর্কেও খোঁজ খবর নেয় এবং উদ্ধার তত্পরতা অব্যাহত রাখে। বেলা ৩টা ১০ মিনিট পর্যন্ত সর্বমোট ৭৮ জন বসিন্দাকে ভবন দুটি থেকে অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা হয়। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রোকন উদ্দীন সকালে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আতিয়া মহল সেনা কমান্ডোদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারা অভিযান শুরু করেছেন।’
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার পাঠানপাড়া সড়কের পাশে অবস্থিত পাঁচতলা ও চারতলাবিশিষ্ট দুটি ভবনের নাম আতিয়া মহল। সিলেট নগরীর আতিয়া ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির বাসিন্দা উস্তার মিয়া। এই বাড়িতে জঙ্গিরা আস্তানা গেড়েছে এমন সন্দেহে শুক্রবার ভোর রাত থেকে বাড়িটি ঘিরে রাখে ঢাকা থেকে আসা কাউন্টার টেরিজম ইউনিটের সদস্যরাসহ পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা। শুক্রবারও দিনভর হ্যান্ডমাইকে করে বারবার সন্দেহভাজন জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। তবে এতে সাড়া মেলেনি। প্রতুত্তরে তারা পুলিশকে ‘শয়তানের দল’ উল্লেখ করে বলে, ‘আমরা আল্লার পথে আছি। প্রয়োজনে জীবন দেব।’
শনিবার সকালে অভিযান শুরুর আগে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান, অ্যাম্বুলেন্স, র্যাব পুলিশের গাড়ি, ফায়ারসার্ভিসসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি সেখানে উপস্থিত রয়েছে। অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথমে আতিয়া মহলে জঙ্গিদের ভবনের বাইরে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভবন মালিক জানিয়েছেন, পাঁচ তলা ভবনটিতে ৩০টি ফ্ল্যাটে মোট ২৮টি পরিবার ভাড়া থাকেন। এই ভবনের নিচ তলার একটি ফ্ল্যাট গত জানুয়ারি মাসে প্রাণ কোমপানির অডিট অফিসার পরিচয়ে কাওসার আহমদ ও মর্জিনা বেগম দমপতি। ওই ‘আতিয়া মহল’কে ঘিরেই চলছে দুদিনব্যাপী এই অভিযান। পুলিশের ধারণা, নারীসহ একাধিক জঙ্গি রয়েছে ফ্ল্যাটের ভিতরে।