আয়না ২৪ প্রতিনিধি
মাহমুদা খানম মিতু খুনের আট মাস পর তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের ভূমিকা নিয়েও কিছু প্রশ্ন তুলেছেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন। হত্যাকান্ডের এতদিন পরও বাদি হিসেবে কিংবা ভিকটিমের স্বামী হিসেবে বাবুল আক্তার খুনিদের বিষয়ে কিছু না বলায় এসব প্রশ্ন দানা বাঁধছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
মোশাররফের এসব বক্তব্য এবং মিতু হত্যার পর গত আট মাসে দেয়া বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট ভিন্নতা আছে বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। মোশাররফ হোসেনের এসব বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের মৌখিক অনুমতিও তিনি দিয়েছেন।
বাবুল আক্তারের বিষয়ে মোশাররফ বলেন, আমরা তো কখনোই বাবুল আক্তার কিংবা কাউকে দোষারোপ করিনি। এখনও দোষ দিচ্ছি না। তবে ধরেন, আমার স্ত্রী খুন হল, আমিই তো সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ থাকব। সবার আগে আমিই তো বলব খুনি কে ? কারণ আমারই তো জানা থাকবে আমার স্ত্রীকে কারা খুন করতে পারে ? স্বামী হিসেবে আমার তো একটা সন্দেহের জায়গা থাকবে, তাই-না ?
‘হতে পারে বাবুল আক্তার অনেক বড় বড় সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে। জঙ্গিদের ধরেছে। জঙ্গিরা মেরেছে কিনা, তাদের সন্দেহ করে কি না সেটা তো বাবুলকেই বলতে হবে। বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, বাবুলকে বলতে হবে তার স্ত্রীকে কে মেরেছে অথবা সে মেরেছে। কারণ বাদি হিসেবে এটা তো তাকে বলতে হবে। ’
মোশাররফ বলেন, বাবুল আমাদের এসব বিষয়ে কিছুই বলেনি। তদন্তকারী কর্মকর্তাকে কিছু বলেছে কি না আমার জানা নেই। যদি বলে থাকে, তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তা সেভাবে কাজ করছে কি না সেটা তো বাবুলই বলতে পারবে। যদি সেভাবে কাজ করত, তাহলে আজ ৮ মাস হয়ে গেল, খুনের মোটিভটা কেন জানা গেল না।
‘যে-ই খুন করুক, যারাই খুন করুক, এটা বের করা খুব সহজ। খুন ছাড়া যে কোন ঘটনার তদন্ত কঠিন, কিন্তু খুনী বের করা সহজ। প্রয়োজনে মোটিভ উদঘাটন করে সবাইকে মাফ করে দেন। সবাইকে ছেড়ে দেন। তারপরও খুনের মোটিভটা বের হোক। ’
‘মেয়ে মানুষ কেন মার্ডার হবে? বিভিন্ন মিডিয়া, বিদেশি সংস্থার লোকজন পর্যন্ত আমাদের বাসায় এসেছে। তাদের কাছেও এটা প্রশ্ন। আমাদেরও প্রশ্ন এটাই, তাকে মারা হল কেন ? তার তো কোন সম্পদ নেই, টাকাপয়সা নেই। ’ বলেন মোশাররফ
হত্যাকান্ডের পর থেকেই সবসময় বাবুল আক্তারকে দায়ী করে কখনও একটি কথাও বলেননি বলে জানিয়েছেন মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলেন, আমি সবসময় পজিটিভ কথা বলেছি। এজন্য আমার আত্মীয়স্বজন অনেকে আমাকে অনেক কথা বলেছেন। তুমি এত পজিটিভ কথা বল কেন, বাবুলের পক্ষে কথা বল কেন, এমন কথাও বলেছে। কিন্তু আমি সবসময় পজিটিভ বলেছি। আমি চেয়েছি, আমার মেয়ে খুনের জন্য নিরীহ কেউ যাতে হয়রানিতে না পড়ে।
‘আমি যদি শুরু থেকেই বাবুলকে আক্রমণ করতাম তাহলে তার ছেলেমেয়ে দুইটাকে আমাদের রাখতে হত। সে নিশ্চয় আমাদের সঙ্গে থাকত না। ছেলেমেয়ে দুইটা তখন হয়তো বাবাও হারাত। ওদের কি দোষ। তারা মা হারা, আমরা মেয়ে হারা। ’ বলেন মোশাররফ
তিনি বলেন, শুরু থেকেই চেয়েছিলাম বাবুল আক্তারই খুনি কে সেটা বের করুক। সেজন্যই আমরা তো চেয়েছি তার চাকরিটা থাক। কেন থাক ? কারণ চাকরি করে বাবুল এটা বের করুক। কারণ চাকরি থাকলে সে স্ত্রীর খুনিটা বের করতে পারবে। এজন্য আমরা চেয়েছিলাম চাকরিটা থাক। এজন্য জোর তদবির করছি।
বাবুল আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও হত্যাকান্ড বা মামলা নিয়ে তেমন কোন কথা বলেও জানিয়েছেন মোশাররফ।
তিনি বলেন, এখন তো সে (বাবুল আক্তার) হাসপাতালে চাকরি করে। মগবাজারে আলাদা বাসা নিয়েছে। তার ছেলেমেয়ে দুইটাকে নিয়ে গেছে। সেখানে তার বাবা-মা, ভাইবোন থাকে। এখন আর এসব নিয়ে কথা হয় না।
বাবুল-মিতুর সংসারে কোন অশান্তি ছিল কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার মা আর বোনকে হয়ত সংসারের বিষয়ে কিছু বলত। কিন্তু আমাকে বলত না। আমার টেনশনটা হয়ত সে বাড়াতে চায়নি। মেয়ে তো। অশান্তি ছিল কি না সেটা বের করার দায়িত্বও তো তদন্তকারী কর্মকর্তার। যেটাই হোক, তদন্তে বেরিয়ে আসুক।
তিনি বলেন, বাবুলের বাবা-মা তো ছেলের বাসায় এসে সবসময় থাকতেন। তারা বলুক সংসারে অশান্তি ছিল কি না। তারাও তো কিছু বলছেন না। আমি বলছি মত্য ঘটনা যা-ই হোক, আমি শুনতে রাজি আছি।
বাবুল আক্তার খুনের বিষয়ে কিছু শেয়ার করেছেন কি না জানতে চাইলে মিতুর মা সাহেদা মোশাররফ বলেন, মেয়ের জামাই কোনদিন এসব বিষয়ে কিছু শেয়ার করেনাই। সে (বাবুল আক্তার) তো এমনিতেই কথা কম বলে। ও কথা একটা বইল্যা আর দুই ঘণ্টায়ও কথা বলবে না। ও তো কথাই কম বলে। জানেন না আপনারা সে কোন প্রকৃতির ?
তিনি বলেন, আমি চাই বাবুল আক্তার আগাইয়া আসুক। সহযোগিতা কি, সে তো এখন চাকরি করে। সে তো এখন সেভাবে সহযোগিতা করছে না আমাদের। চাকরি নিয়ে তো ব্যস্ত। যোগাযোগ আছে। মামলা নিয়ে কথাবার্তা কম হচ্ছে। বাবুল আক্তার খুনীর বিষয়টা কখনও বলেনাই।
মোশাররফ হোসেন বলেন, এই যে আমরা আজকে এখানে আসলাম, বাবুলেরও তো আসা উচিৎ ছিল। তার তো এসে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলা উচিৎ ছিল এটা আমার শ্বশুর, এটা শ্বাশুড়ি। কিন্তু এই মামলা নিয়ে বাদি হিসেবে সে কি করছে সেটা তো আমরা জানতে পারছি না।
‘মিতুর মোবাইল থেকে মাঝে মাঝে মিসকল আসে’
মিতু হত্যার পর তার খোয়া যাওয়া মোবাইল থেকে মাঝে মাঝে মিসকল আসে বলে জানিয়েছেন তার মা সাহেদা মোশাররফ। আর বৃহস্পতিবার সকালে তদন্তকারী কর্মকর্তার সামনেও মিতুর মোবাইলে ফোন করে সেটি খোলা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন মোশাররফ।
সাহেদা বলেন, মিতুর নম্বরে আমি কথা বলছি। ওই লোকটা বলছে আমি সিএনজি চালক। হাতিরঝিলে মোবাইলের সিম পেয়েছে। মগবাজারে থাকি। আমি বলছি, আপনার সঙ্গে আমি কথা বলব, বিরক্ত হইয়েন না। আমার একটা ছেলে। মামী আমার সঙ্গে থাকে। ঠিকানা চাওয়ার পর ফোন কেটে দেয়।
‘মাঝে মাঝে সে মিসকল দেয়। আমি কল করলে কথা বলে। আবার মাঝে মাঝে কেটে দেয়। সে সিএনজি চালক বলে নিজেকে পরিচয় দিয়েছে। ‘ বলেন সাহেদা
মোশাররফ বলেন, বৃহস্পতিবার সকালেও তদন্তকারী কর্মকর্তার সামনে আমি ওই মোবাইলে ফোন করেছি। হ্যালো বলার পর আমি কেটে দিয়েছি। তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বারবার বলছি ফোনটা উদ্ধার করেন। কিন্তু এটা করছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর) মো.কামরুজ্জামান বলেন, মিতুর মোবাইলের বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। বিষয়টা একটু টেকনিক্যাল। আইটি এক্সপার্ট টিম কাজ করছে। কিন্তু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) মিতুর মা সাহেদা মোশাররফকে সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত একটানা জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। সাহেদাকে নিয়ে সিএমপিতে আসা মোশাররফকেও শুরুতে এবং শেষে কিছুক্ষণের জন্য স্ত্রীর সামনে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর বাবুল আক্তারও সিএমপিতে এসে তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন। স্ত্রী খুনের মামলার বাদি হিসেবে ওইদিন বাবুল আক্তার সিএমপিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা কামরুজ্জামানের কার্যালয়ে হাজির হয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন।
এরপর বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফকে ২২ ডিসেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
বাবুল আক্তারের মা-বাবা এবং দুই খালাতো ভাইকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
গত বছরের ৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় নগরীর ও আর নিজাম রোডে দুর্বৃত্তদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত ও গুলিতে নিহত হন সদর দপ্তরে কর্মরত তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। এ ঘটনায় বাবুল আক্তার নিজে বাদি হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।