আয়না ২৪ প্রতিনিধি
মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আগের রাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই নেওয়া হয়েছে এসএসসির ঢাকা বোর্ডের গণিতের পরীক্ষা।
একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে পরীক্ষার্থী সেজে প্রতিবেদক শনিবার রাতে গণিতের যে প্রশ্ন পেয়েছিলেন, হুবহু সেই প্রশ্নেই গণিতের সৃজনশীল ও এমসিকিউ অংশের পরীক্ষা হয়েছে। এসএসসিতে রোববার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত গণিত (আবশ্যিক) বিষয়ের পরীক্ষা হয়। দুপুরে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র দেখার পর মিলিয়ে ফাঁস হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গত কয়েক বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চললেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বরাবরই তা নাকচ করা হচ্ছিল। এর আগে চলতি এসএসসির বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। তবে কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এসএসসি, জেএসসিসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছে, পাবলিক পরীক্ষায় বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও চক্রটির উৎস বের করতে পারছে না সরকার। এ কারণে বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে।
এবার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হলে তার বিস্তারিত শুনে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার একে উদ্বেগের বিষয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, শনিবার রাতে বোর্ডে কর্তৃপক্ষও কথিত ফাঁস হওয়া একটি প্রশ্নপত্র পেয়েছিল। তবে তার সঙ্গে মূল প্রশ্নপত্র মেলেনি।
তবে সকাল সাড়ে ৯টায় যে প্রশ্ন তারাও পেয়েছিলেন, তা মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিলে গেছে বলে স্বীকার করেন তপন কুমার। এ বিষয়ে কথা বলতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে রোববার রাতে যোগাযোগ করা হলে তার মোবাইল নম্বরগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইনেরে মোবাইলে কল করলে তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও সাড়া দেননি তিনি।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক উপ-কমিটির আহ্বায়ক তপন কুমার বলেন, আমাদের সহযোগিতা করলে অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখব। গোয়েন্দা সংস্থাকে ওইসব তথ্য জানান। কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস হল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ধারণা ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন বের করে কেউ ওই প্রশ্ন বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
তপন কুমার জানান, বিজি প্রেসে ছাপা হওয়ার পর পরীক্ষা শুরুর ১৫ থেকে ২০ দিন আগে সিল করা প্রশ্ন পাঠানো হয় বিভিন্ন জেলার ডিসি অফিসে, রাখা হয় সেখানকার ট্রেজারিতে।
ডিসি অফিসের ট্রেজারি থেকে পরীক্ষা শুরুর তিন দিন আগে প্রশ্ন যায় প্রতি উপজেলার থানায়। থানা থেকে পরীক্ষার দিন সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রশ্ন পাঠানো হয়। পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে সিল করা প্রশ্নের ফাইল খুলতে হয়।
যেভাবে মিলল প্রশ্ন
SSC Exam Question 2017 Only Dhaka Board নামে একটি ফেসবুক পাতায় ৯ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টা ১৭ মিনিটে ঘোষণা দেওয়া হয়, ১০০০% কমন গণিত প্রশ্ন দিব. Per Sub 800. কসম খেয়ে বলতে হবে যে কমনের পর টাকাটা দিবে। আর কাউকে শেয়ার করবা না। বা করলেও ১ জনের সাথে। যদি রাজি থাকো তাহলে What’s up এ মেসেজ দিয়ে গ্রপে এড হও। What’s up number 01744681139 call দিলে Block দিব।
ওই মোবাইল নম্বরে শনিবার রাত ৮টা ১০ মিনিটে যোগাযোগ করা হলে রাত ৮টা ৫৬ মিনিটে হাতে লেখা গণিতের সৃজনশীলের এক সেট প্রশ্ন ইমেজ আকারে পাঠানো হয়। কখন, কীভাবে টাকা পরিশোধ করতে হবে জানতে চাইলে সে বিষয়ে কোনো আলোচনায় না গিয়ে রাত ৯টা ৮ মিনিটে ওই নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ গণিতের ছাপানো ‘খ’ সেট সেট প্রশ্ন দেওয়া হয়।
রাত ৯টা ৫৩ মিনিটে আসে ‘খ’ সেট প্রশ্নের হাতে লেখা উত্তর। ওই নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে রাত ২টা ৪০ মিনিটে টেক্সট মেসেজ আসে- মন দিয়ে শেষের ২টা সেট শেষ কর। সকাল ৮টায় জানাবো কোন সেট আসবে, এমসিকিউ সকালে উত্তরসহ পাবা।
এরপর রাত ২টা ৪০ মিনিটে ‘ক’ সেটের ছাপানো প্রশ্ন দেওয়া হয়। রোববার সকাল ৬টা ৪৬ মিনিটে ছাপানো এক সেট এমসিকিউ প্রশ্ন পাঠিয়ে বলা হয়, সম্ভবত সেট চেইঞ্জ হয়েছে, এটা পড়।
সকাল ৬টা ৪৮ মিনিটে আবারও গণিতের সৃজনশীলের ‘ক’ সেট প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে বলা হয়, রাতে ‘খ’ সেট দিয়েছি আর এখন যে সেট (‘ক’ সেট) দিলাম সেখান থেকেই থাকবে ১০০০%। তাই মেসেজ না করে পড়ায় মন দাও ভালো কিছু করতে পারবা।
সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটে ছাপানো এমসিকিউ প্রশ্ন উত্তরসহ পাঠিয়ে বলা হয়, ১০০% কমন। ওই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে শনিবার রাত ২টা ৪০ মিনিটে ‘ক’ সেটের সৃজনশীল অংশের যে প্রশ্ন দেওয়া হয় রোববার সেই প্রশ্নেই পরীক্ষা হয়েছে। রোববার সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটে যে এমসিকিউ প্রশ্ন উত্তরসহ দেওয়া হয়েছিল, সেই প্রশ্নও হুবহু মিলেছে।
এদিকে রোববার সকাল ১১টা ৯ মিনিটে ওই নম্বর থেকে হোয়াটঅ্যাপ মেসেজে বলা হয়, আমার কাজ আমি করেছি। এখন তোমাদের পালা। যারা মনে কর সারা রাত তোমাদের জন্য আমি একটুকু হলেও কষ্ট করেছি তারা আমার কষ্টের ফল দিবা। আর যারা আমার কথা বিশ্বাস করে না তারা আমায় ভুলে যাও আর ব্লক দাও। আর আমি তোমাদের শেষরাতে যে সেট সেই সেটই আসছে। আর এমসিকিউটাও রাতেই দেওয়া হয়েছে। বিশ্বাস না হলে আমার দেওয়া পুরাতন প্রশ্নের সাথে মিলাও। বেশি কথা বলবো না। আমায় তুমি জীবনের সর্বস্তরে পাবা।
আমি সব ধরনের পাবলিক পরীক্ষায় কাজ করি। তাই মনে রেখ ভাই আমি সব সময় তোমাদের ভালো চাই। হয়ত গণিতটাতে প্রোবলেম হইছে। আর ভাই সামনে আরও এক্সাম আছে মন দিয়ে পড় আর আমিতো আছিই সব ধরনের সাহায্যের জন্য। আর আজ আমার কষ্টের ফল যে দিবে আমি তাদেরকে মনে রাখবো। আজ কসম আমি তাদেরকে মনে রাখব। আজ কসম আমি তাদেরকে ইসলাম আর শারিরীক শিক্ষা ফ্রিতে দেব ১০০%। তাই বলি যারা শ্রমের মর্যাদা বোঝ তারাই আমায় নখ (নক) কর। না হলে আর নখ (নক) করো না ভাই।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সূত্র জানিয়েছে, এর আগে কয়েকটি পরীক্ষার সময় তাদের কাছে অভিযোগ ছিল, পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে আগে কোনো কোনো কেন্দ্রে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুলে কিছু অসাধু শিক্ষক মোবাইলে ছবি তুলছেন। তারপর পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে ছবিগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে। এ জন্য এবার পরীক্ষার কেন্দ্রে ছবি তোলা যায়, এমন মোবাইল নেওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়। এরপরও একই ধরনের অভিযোগ উঠল।
এর আগে ২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় দেশে আলোচনার ঝড় উঠলে তদন্ত শুরু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্তে প্রমাণ হয়, ঢাকা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজি ও গণিত (তত্ত্বীয়) দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র হুবহু ফাঁস হয়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের নমুনা ফরিদপুর থেকে পাওয়া গেলেও ফাঁসের সুনির্দিষ্ট উৎস বের করতে পারেনি প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি। তখন কমিটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করে উৎস বের করার সুপারিশ করা হলেও উৎস আর বের হয়নি। ২০১৩ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগও সরকারি তদন্তে প্রমাণিত হয়। কিন্তু তখনো উৎস বের করা যায়নি।