আয়না২৪ প্রতিবেদনঃ
রাজধানীর পরীবাগে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন দিগন্ত টাওয়ারের সাত তলা থেকে ফেলে দেওয়া গৃহকর্মীর চিকিৎসা ও পরিবারের খরচ যোগানো নিয়ে দিশেহারা তার স্বজনরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৩৫ বছরের ওই নারীর ডান হাত ভেঙেছে, পিঠে গুরুতর আঘাতের কারণে পারছেন না নড়াচড়া করতে, জখম হয়েছে তার মুখেও।
ধর্ষণে বাধা দেওয়ায় দিগন্ত টাওয়ারের ৭/এম ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এ জেড এম সালেহ আহমেদ শুক্রবার সন্ধা রাতে তাকে সাত তলা থেকে ফেলে দেয় বলে তার অভিযোগ।
শনিবার রাতে মিরপুর থেকে সালেহ আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জাফর আলী বিশ্বাস জানিয়েছেন। বাসার নিচ থেকে আটক করা হয়েছে তার ব্যবহৃত একটি গাড়ি, যাতে জাতীয় সংসদের মনোগ্রামযুক্ত স্টিকার লাগানো রয়েছে। পরীবাগের বিলাসবহুল দিগন্ত টাওয়ারে এ জেড এম সালেহ আহমেদ ও তার বাবার দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে
ওই রাতে সালেহর বাবা আবুল হোসেনকেও আটক করা হয়। দিগন্ত টাওয়ারের আরেকটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হোসেন বিএনপির সহযোগী সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি। তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রোববার আদালতে পাঠানো হয় বলে পরিদর্শক জাফর জানান।
হাসপাতালে ওই গৃহকর্মী জানান, বাড্ডার নাজমা আক্তার নামের এক নারীর মাধ্যমে গত ১৬ জুন পরীবাগের এই বাসায় মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতনে কাজ নেন তিনি। কাজ শুরুর পরদিনই গৃহকর্তা তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেন। ওই বাসায় মনোয়ারা বেগম নামে একজন বৃদ্ধাও আট হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন। বাসায় সালেহ আহমেদের স্ত্রী পরিচয় দেওয়া সীমা নামের আরেক নারী থাকতেন। সালেহ আহমেদ বাসার বাইরে গেলে সবাইকে তালাবন্ধ করে রেখে যেতেন। প্রায়ই বাসায় বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা আসত। তারা একটা রুমে ইয়াবা সেবন করত।
রোববার দুপুরে হাসপাতালে ওই নারীর শয্যার পাশে বসে চোখের জল মুছছিলেন মা মাসুমা বেগম। আরেক পাশে ছিলেন ভাই গাড়িচালক শুক্কর আলী। আর তার মাথার কাছে বসে ছিল তার কিশোর ছেলে।
মাসুমা বেগম বলেন, আমার মেয়ে তো কোনো অন্যায় করেনি। তার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। তাকে অন্যায় কাজে বাধ্য করতে চাওয়া হয়েছিল। নিজেকে রক্ষা করতে চাওয়ায় বাড়ির মালিক তাকে সাত তলা থেকে ফেলে দেয়। এখন মেয়ের চিকিৎসার খরচ কীভাবে চালাব জানি না।
তার ভাই বলেন, বনানীতে একটি বাসার গাড়ি চালান তিনি। বোনের চিকিৎসার জন্য বেতনের বেশ কিছু টাকা এরইমধ্যে তোলা হয়ে গেছে।
এখন মালিক ছুটিও দিতে চাইছে না। হাসপাতালে অনেকগুলো টেস্ট করতে দিয়েছে। এজন্য যে টাকা দরকার, সেটা আমাদের কাছে নেই। কেউ চিকিৎসার খরচ মেটানোর জন্য এগিয়ে না এলে আমার বোনের চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে না।
অসহায় দৃষ্টিতে ওই গৃহকর্মী বলেন, পেটের দায়ে মানুষের বাসায় কাজ করতে গেসিলাম। অনেক বছর আগে স্বামী ছেড়ে গেছে। দুই সন্তান আর বাবা-মাকে দেখতে হয়। পড়াশোনা জানি না বলে মানুষের বাসায় কাজ করে খেতে হয়।
দিগন্ত টাওয়ারের ওই ফ্ল্যাটে গত শুক্রবার সালেহ আহমেদ, তার কথিত স্ত্রী সীমা, গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগম এবং ওই গৃহকর্মী ছিলেন।
ষাটোর্ধ্ব মনোয়ারা রোববার বিকালে শাহবাগ থানায় বলেন, সেদিন স্যার আর ম্যাডাম (সীমা) এক রুমে অনেকক্ষণ দরজা বন্ধ করে ছিলেন। তারা প্রায়ই রুমের দরজা বন্ধ করে মোম জালিয়ে কী যেন খাইত। মাঝে মাঝে দুইটা মেয়েও আসত। তারা সবাই এক রুমে দরজা বন্ধ করে রাখত। এরপর স্যার প্রায়ই অন্যরকম ব্যবহার করত।
ওই গৃহকর্মী মেয়েটাকেও স্যার মাঝে মাঝে রুমে ডেকে আটকে রাখত। এরপর মেয়েটা বের হওয়ার পর শুধু কান্না করত। কিছু জানতে চাইলে কোনো কথা বলতে চাইত না।
অপর গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগম জানান, সালেহের হাতুড়ি পেটায় গত মাসেও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। মনোয়ারা বলেন, স্যার-ম্যাডাম রাতে ডাবের পানি খান। শুক্রবার বিকেলে স্যার রুম থেকে বের হয়ে ওই মেয়েটাকে ডাবের পানি দিতে বললে সে জানায়, ডাব নেই। এরপর স্যার রেগে গিয়ে তাকে লোহার পাইপ দিয়ে মারধর করেন। হাতে থাকা হাতুড়ি দিয়ে তার স্ত্রী সীমা ম্যাডাম ও আমাকেও প্রচণ্ড মারতে থাকেন।
সন্ধ্যার পর ম্যাডাম আর আমাকে স্যার বাসা থেকে বের করে দেন। আবার দারোয়ানকে ফোনে বলে দেন, আমরা যেন বাসার বাইরে যেতে না পারি। আমরা ফ্ল্যাটে যেতে গেলে স্যার ম্যাডামকে বাসায় ঢুকতে দিয়ে আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এরপরই শুনতে পারি, স্যার ওই মেয়েকে নাকি সাত তলা থেকে ফেলে দিয়েছেন।
এই ঘটনায় গৃহকর্মীর মা মাসুমা বেগম শনিবার শাহবাগ থানায় এসে ধর্ষণে বাধা দেওয়ায় তার মেয়েকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেছেন বলে জানান পরিদর্শক জাফর।
তিনি বলেন, মামলার আগেই মৌখিক অভিযোগ পেয়ে সালেহ আহমেদের সন্ধানে শুক্রবার রাতেই তারা দিগন্ত টাওয়ারের ওই ফ্ল্যাটে অভিযান চালান। বাসার দরজা ভেঙে সেখান থেকে সালেহর স্ত্রী পরিচয় দেওয়া একজন নারীকে উদ্ধার করা হয়।
মনোয়ারা বেগম আরও বলেন, সালেহ এর আগেও তাকে মারধর করতেন । আগের মাসেও স্যার আমাকে হাতুড়ি দিয়ে প্রচণ্ড মারধর করার পর ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছিলাম।
সালেহ ও তার বাবার পেশা কী জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, তাদের মাটিকাটার কয়েকটি যন্ত্র রয়েছে। এছাড়া বনানী ও পুরান ঢাকায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা আছে।
সালেহ কিছু দিন অস্ট্রেলিয়া ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানেও তাদের রেস্তোরাঁ ব্যবসা আছে বলে শোনা গেছে।
এদিকে র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শনিবার পরীবাগের দিগন্ত টাওয়ারের পার্কিং থেকে নতুন মডেলের হিয়োন্দে-এইচ ওয়ান মডেলের একটি মাইক্রোবাস উদ্ধার করে তারা। গাড়িতে জাতীয় সংসদের মনোগ্রাম লাগানো ছিল। গাড়িটি এজেডএম সালেহ আহমেদ ব্যবহার করতেন বলে স্থানীয়রা র্যা বকে জানিয়েছেন।
এর আগে ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর শাহবাগ এলাকায় র্যাবের একটি বিশেষ অভিযানে সালেহ আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
সে সময় তার কাছ থেকে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ও নগদ ৮ লাখ টাকা, ২৩টি ইয়াবা বড়ি এবং জাতীয় সংসদের মনোগ্রাম খচিত নম্বর প্লেট বিহীন একটি নতুন মার্সিডিজ বেঞ্জ জিপ গাড়ি উদ্ধার করা হয়।
“র্যাবের অনুসন্ধানে জানা গেছে সালেহ আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে পরীবাগে তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে ইয়াবা সেবন, বিকৃত যৌনাচার, হুন্ডি ও মাদক ব্যবসাসহ অন্যান্য অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত।”
গৃহকর্মীকে সাততলা থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানতে দুপুরে দিগন্ত টাওয়ারে গিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ফ্ল্যাটের ম্যানেজারের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টার পর ইন্টারকমের অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়, এই বিষয়ে ভবনের কেউ কথা বলতে চান না। তাই কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিকিউরিটি সুপারভাইজার বলেন, দিগন্ত টাওয়ারে প্রায় দেড় শতাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন এখানে বসবাস করেন।