আয়না২৪ ডেস্ক
রাজধানী ঢাকায় বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। গত ছয় বছরে কেবল ঢাকা মহানগরে প্রায় ৩১ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ১৪টি, মাসে ৪২৯টি এবং বছরে পাঁচ হাজার ১৪৩টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনেকারীদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে নারীরা।
মোদ্দকথায়, বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যাগত দিকটি ঝোড়োগতির বলতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে করে দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় চলছে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘূর্ণিঝড়। এতে ভাঙছে সংসার এবং তছনছ হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন।
সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা মহানগরীতে গত ছয় বছরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ। এক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে তালাকে এগিয়ে রয়েছেন মহিলারা। রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় বছরে বিবাহবিচ্ছেদের নোটিশ পড়েছে ৩৬ হাজার ৩৭১টি। বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে ৩০ হাজার ৮৫৫টি। এর মধ্যে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী তালাক দেয়ার নোটিশ পড়েছে ১২ হাজার ১৮টি। তবে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে তালাকের নোটিশ পড়েছে ২৪ হাজার ৮০৩ টি। এই হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ১৪টি, মাসে ৪২৯টি এবং বছরে পাঁচ হাজার ১৪৩টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মহানগরীতে খুবই আশঙ্কাজনক হারে তালাক দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যা কিছুদিন আগেও ছিল কল্পনাতীত।
সূত্র বলছে, বিবাহ ও বিচ্ছেদ নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা গবেষণা শুরু করেছেন ১৯৯৫ সাল থেকে। যা এখনও চালু রয়েছে। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, যেসব আবেদন ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে তার মধ্যে ৮৭ শতাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে পরকীয়ার জের ধরে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালে ঢাকা শহরে মোট তালাক নোটিশের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৭৫৩টি, ২০০১ সালে দুই হাজার ৯১৬টি, যার মধ্যে তালাকের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৫৪০টি, ২০০২ সালে নোটিশের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৭৩টি, এর মধ্যে তালাক হয়েছে দুই হাজার ৬১৫টি, ২০০৩ সালে নোটিশ এসেছে তিন হাজার ২০২টি, এবং এর মধ্যে তালাক হয়েছে দুই হাজার ৯৬১টি, ২০০৪ সালে তালাকের নোটিশ এসেছিল তিন হাজার ৩৩৮টি, এবং আপস হয়েছে ৩৩৮টি।
এরমধ্যে উত্তর সিটির হিসাব মতে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত সংস্থাটির পাঁচটি অঞ্চলে মোট ২০ হাজার ৫৮৪টি তালাকের নোটিশ পড়েছে। এর মধ্যে স্বামীর পক্ষ থেকে সাত হাজার ১৯ এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে ১৩ হাজার ৪৬৫টি। নোটিশ প্রত্যাহার হয়েছে ৪৬৫টি এবং কার্যকর হয়েছে ১৬ হাজার ৬২১টি। তিন হাজার ৫১৮ নোটিশ চলমান। অন্যদিকে, দক্ষিণ সিটির পাঁচটি অঞ্চলে বিচ্ছেদের নোটিশ পড়েছে ১৫ হাজার ৭৮৭টি। এর মধ্যে স্বামীর পক্ষ থেকে চার হাজার ৯৯৯টি, স্ত্রীর পক্ষ থেকে ১০ হাজার ৮০৩টি। নোটিশ প্রত্যাহার হয়েছে ৩৪৮টি এবং কার্যকর হয়েছে ১৪ হাজার ২৩৪টি।
তালাক দেয়ার দিক থেকে নারীরা এগিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়, পুরুষত্বহীনতা, মতের অমিল এবং তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার ও এর মাধ্যমে অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে অবাধ যোগাযোগ এর অন্যতম কারণ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর অঞ্চলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবু নাসের বলেন, সংসার ভাঙতে নারীরা এগিয়ে থাকার কারণ হল নারীরা এখন অর্থের দিক থেকে খুব স্বাধীন। যে কোনো সিদ্ধান্ত তারা নিজেই নিতে পারে। এ ছাড়া তথ্য প্রযুক্তির কারণে এসব ঘটনা বেশি ঘটছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে নারীদের ওপর অবিচার করা হয়। পুরুষের দোষ থাকার পরও পরিস্থিতির স্বীকার করে তাদের তালাক দেওয়া হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর অঞ্চলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সানাউল হক বলেন, বিবাহবিচ্ছেদের মতো স্পর্শকাতর ঘটনার আবেদন প্রতিবছর আমাদের সালিশি বোর্ডের কাছে যে হারে পড়ছে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। সামাজিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেকেই সালিশি বোর্ড কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আসেন না। অনেক সময় পারিবারিক এবং সামাজিকভাবেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়ে থাকে। তবে যে অভিযোগগুলো আসে তাতে দেখা যায়, স্বামী পক্ষের যৌতুক দাবি, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, মাদকাসক্তি, পরকীয়া, দু’জনের জীবনযাপনে অমিল, সন্দেহপ্রবণতা, স্বামীর কাছ থেকে ভরণ-পোষণ না পাওয়া, স্ত্রীর অবাধ্য হওয়া, ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক সম্পর্কে জড়ানো এবং ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী জীবনযাপন না করায় তালাকের ঘটনা ঘটছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী বলেন, মেয়েদের পক্ষ থেকে বেশি তালাক দেওয়ার মূল কারণ হল তারা এখন অনেক বেশি অধিকার পেয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুইদিক থেকেই বেশি অধিকার পেয়ে স্বামীকে তালাক দিতে আগের চেয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। আগেরকার দিনের মায়েরা যেমন সংসার ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতো। এখন একক পরিবার ও বাইরে চাকরি ও সার্বিক স্বাধীনতার কারণে বাইরের মানুষের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে। এক্ষেত্রে স্বামীদের চেয়ে বাইরের বন্ধু-বান্ধবদের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। তাই পারিবারিক অবস্থা একটু খারাপ হলেই তালাকের চিন্তা করে। মনে করে অন্য কাউকে খুঁজে নিব। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরা খুব বেশি অত্যাচারী হয়। কিন্তু আগের দিনের মায়েদের ক্ষেত্রেও এগুলো ঘটেছে। তারা সহ্য করতে চাইতো। যেটা এখন কেউ করে না। অনেক ছোট ছোট কারণেও তারা তালাকের সিদ্ধান্ত নেয়।
এছাড়া, তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আধুনিক সংস্কৃতির কারণেও বেশি সংসার ভাঙছে। বর্তমানের মেয়েরা বিদেশী টেলিভিশন, স্টার জলসা, জি বাংলাসহ বিভিন্ন ধরনের সিরিয়াল দেখে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে।
বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পারিবারিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। পারিবারিকভাবে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হলে সবাই এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যত্নবান হবেন।