আয়না২৪ প্রতিবেদক
বাঙ্গালী জাতির এক অবিস্মরণীয় দিন আজ। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এর ২১৪ বছর পর পলাশির আম্রকাননের অদূরে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার প্রধানদের শপথের মাধ্যমে বাংলাদেশ যাত্রার এক নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারত গমনের সময় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল রণাঙ্গনের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই এলাকার নিরাপত্তা ও ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ১৪ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করেন।
প্রথম দিকে চুয়াডাঙ্গাতে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ায় কথা থাকলেও যুদ্ধ পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে শপথ গ্রহণের স্থান চুয়াডাঙ্গার পরিবর্তে ইপিআর-উইং-এর অধিন মেহেরপুর সীমান্ত এলাকা বৈদ্যনাথতলা মনোনিত করা হয়।
দিনের পর দিন মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ যুদ্ধের পরেও স্বীকৃতি না পেয়ে যখন তাদের মনোবল ভাঙ্গতে শুরু করে ঠিক এমনই এক সংকটকালীন সময়ে ভারতীয় বিএসএফ’র উর্দ্ধতন কর্মকর্তা গোলক মজুমদার ও ৭৬ ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল চক্রবর্তী বৈদ্যনাথতলায় এসে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি এবং মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌহিক-ই-এলাহী সহ আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে বৈদ্যনাথ তলায় (বর্তমানে মুজিবনগর স্মৃতি সৌধ) জায়গা দেখিয়ে মঞ্চ তৈরীর প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বলেন।
আপামর জনতা স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে ১৬ এপ্রিল সকাল থেকে সারারাত ধরে মঞ্চ তৈরি, বাঁশ দিয়ে বেষ্টনী নির্মান এবং স্থানীয়ভাবে ভাঙ্গা চেয়ার টেবিল দিয়েই আয়োজন সম্পন্ন করেন। আনুসঙ্গিক সরঞ্জাম আসে ভারতের হৃদয়পুর বিএসএফ ক্যাম্প থেকে। অত্যন্ত গোপনিয়তার সাথে আয়োজন সম্পন্ন করা হয়।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১, সেই মাহিন্দ্রক্ষণে তাজ উদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে সকাল নয়টার দিকে বৈদ্যনাথ তলায় পৌছান। ইতিমধ্যে দেশী বিদেশী শতাধিক সাংবাদিক এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও আসেন। তার মধ্যে ছিলেন বিট্রিষ সাংবাদিক মার্ক টালি ও পিটার হেস। বহু প্রতিক্ষিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল এগারটায়।
মেজর আবু উসমান চৌধুরীর পৌছাতে বিলম্ব হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ইপিআর আনসারের একটি ছোট্র দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পিদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সৈদয় নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
গৌরিনগরের বাকের আলীর কোরআন তেলওয়াত এবং ভবরপাড়া গ্রামের পিন্টু বিশ্বাসের বাইবেল পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এরপরে আওয়ামীলীগের চিফ হুইফ অধ্যাপক শেখ মোঃ ইউসুফ আলী বাংলার মুক্ত মাটিতে স্বাধীনতাকামী কয়েক হাজার জনতা এবং শতাধিক দেশী বিদেশী সাংবাদিকের সামনে দাঁড়িয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা পত্র পাঠ করেন।
ঐতিহাসিক সেই স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে চিফ হুইফ অধ্যাপক ইউসুফ আলী রাষ্ট্র প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শপথ বাক্য পাঠ করান।
এরপর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজ উদ্দীন আহমেদের নাম ঘোষনা করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য আইন, সংসদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদ, স্বরাষ্ট মন্ত্রী হিসেবে এএইচএম কামরুজ্জামান এবং অর্থ মন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং শপথ পাঠ করান।
মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্ণেল এম এ জি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে কর্ণেল আব্দুর রবের নাম ঘোষনা করা হয়। এরপরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমেদ উপস্থিত সকলের সামনে ৩০ মিনিটের এক উদ্দিপনাময় ভাষন দেন। ভাষনে তিনি বলেন আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে এ বৈদ্যনাথতলা। এবং এর নতুন নাম হবে মুজিবনগর। তিনি ভাষণে বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিদান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান।
বক্তব্য এবং শপথ গ্রহণ পর্ব শেষে নেতৃবৃন্দ মঞ্চ থেকে নেমে এলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন মেজর আবু উসমান চৌধুরী। উপস্থিত জনতার জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মুজিবনগরের আম্রকানন। সব মিলিয়ে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়।